সা ক্ষা ৎ কা র
কথাসাহিত্য সে অর্থে বদলায়নি
শিমুল জাবালি
🕐 ১২:২৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০১৮
কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা। ‘ডুগডুগির আসর’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’। কথা বলেছেন শিমুল জাবালি
কথাসাহিত্যের বর্তমান সময়ে আমরা যে টেক্সট পাই বা পাঠ করি, আর পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের টেক্সট বা পাঠ ভিন্ন মনে হয় কি না?
তাত্ত্বিক অর্থে বা চিন্তার জায়গা থেকে পাঠকে যেভাবে ভাবি সে অর্থে যাওয়ার দরকার নেই। বরং আজকের উপন্যাস আর পঞ্চাশ বছর আগের উপন্যাসের ভেতরে কোনো মৌলিক তফাৎ আছে কি না, সেটাই বলা উচিত। বাংলা ভাষার উপন্যাসের বয়স যদি পৌনে দুইশ বছর বা এর কাছাকাছি হয়, তাহলে যে উপন্যাসগুলো স্বার্থক উপন্যাস, সেগুলো থেকে আজকে যে উপন্যাস রচিত হচ্ছে তার ভেতরে সময়ের কারণে, বিষয়ের কারণে, জনজীবনের পরিবর্তনের কারণে বদল নিশ্চয়ই ঘটেছে । কখনো কখনো আজকের ঔপন্যাসিক উপন্যাস লিখছেন আজ থেকে সত্তর, পঁচাত্তর এমনকি একশ বছর আগের ঘটনা নিয়ে। তবে আগের ঘটনা নিয়ে লিখছেন ঠিকই কিন্তু লিখিত হচ্ছে প্রায় আজকের গদ্যে।
ব্যাপারটা কি এরকম, প্লট একটা জায়গাতেই আছে, কিন্তু ভাষার জায়গাটায় পার্থক্য গড়ে উঠেছে...
সেটা ঘটতে বাধ্য। জনজীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে ভাষার পরিবর্তন ঘটবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাহলে ভাষাটি মারা যাবে। যেসব ভাষা পরিবর্তনকে মানেনি, সেগুলো মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। যেসব ভাষাকে বৈয়াকরণিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সেগুলো অনেকটাই মারা গেছে। উপন্যাস শিল্পমাধ্যমে ওই পরিবর্তনটি আমার কাছে খুব বড় মনে হয়নি। পরিবর্তনের বড় সুযোগ হতে পারত যদি উপন্যাসের চলমানতায় বড় কোনো পরিবর্তন সাধিত হতো। তার কৌশলের দিক থেকে, জনজীবনকে বোঝার দিক থেকে, লিখবার দিক থেকে। খুব দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে বাংলা উপন্যাস এখনো পর্যন্ত তার শুরুর পর্বে যে ফর্মে-কৌশলে লেখা হতো, তার থেকে খুব বেশি সরে আসেনি। রবীন্দ্রনাথের পরে যাদের হাতে বাংলা উপন্যাসে ভাষার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে তারা হলেন- মানিক, বিভূতি এবং সতীনাথ ভাদুরী।
ত্রয়ী ঔপন্যাসিকের পর বলা হয়ে থাকে কমলকুমার ও অমিয়ভূষণ উপন্যাসের আধুনিকায়নের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই সেই আধুনিক স্রোত খুব একটা জনপ্রিয় বা বেশিদূর এগোয়নি। এর কারণ কি হতে পারে?
তারা যে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং যেটাকে সরাসরি ‘আধুনিক’ বললেন এ জায়গায়টায় আমার বলবার আছে। সেটি হলো তারা যে চেষ্টা করেছেন, সে চেষ্টাটা তাদের মতো করেছেন, সেটি পৃথক হবার কোনো ইচ্ছা থেকে করেননি, এবং তারা দুজন নিঃসন্দেহ বড় ঔপন্যাসিক। কিন্তু সেটি কোনো পৃথক রাস্তা বুঝেশুনে ইচ্ছে দিয়ে তৈরি করেননি, তারা লিখবার কায়দাটাকে ওভাবে ভাবতেন তাই তারা ওইভাবে লিখেছেন। এবং তারা তাদের মতো লিখেই বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক। তবে অমিয়ভূষণ সামগ্রিক চেষ্টায় একটা পৃথক গড়ন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
অমিয়ভূষণের রচনায় দেখা যায় তিনি পেছনের দিকে হেঁটেছেন। চরিত্র বলি, অনুষঙ্গ বলি কিংবা অন্যান্য, প্রায়কিছুই মহাভারত, মনসামঙ্গল কিংবা অন্যান্য পুরানঘেঁষা। এই যে প্লটের দিক থেকে অনুভবের দিক থেকে শিকড়ে চলে যাবার চেষ্টা। এ চেষ্টাটা ঔপন্যাসিকের ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োজন?
শেকড় খোঁজার টার্গেট নিয়েই লিখেছেন এটা আমার মনে হয়নি। তিনি যে ব্যাপারটা ভালো জেনেছেন, বুঝতে পেরেছেন, ধরতে পেরেছেন ওটাই লিখেছেন। ওই শেকড়-টেকড় খোঁজার ব্যাপার আসলে তাত্ত্বিক বা অধ্যাপকীয় জায়গা থেকে বলা হয়।
আজকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্লট কতটা গুরুত্ব বহন করে?
উপন্যাসে প্লট থাকতে পারে। আজকের উপন্যাসে প্লট-কাহিনী দাবি-টাবি করে বলে আমার মনে হয় না। উপন্যাস কোনো কাহিনী নয়। বাংলা ভাষায় যে উপন্যাস লেখা হয় তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগই উপন্যাসের নামে কাহিনী লেখা হয়। বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারি সেগুলোকে উপন্যাস বলে না।
যারা এরকম লিখতেছেন তাদের প্রতি আপনার নিবেদন কি?
দেখুন আমি কোনো ফুটবল টিমের কোচ নই। তাকে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব আমার নয়। এসব দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতাও রাখি না। নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এসবের দরকার হয় না।
বিদেশি উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন মার্কেজের লেখায় ম্যাজিক রিয়েলিজম কাজ করে বলা হয়ে থাকে। বাংলা উপন্যাসে তা দেখা যায় কি না?
এগুলো তাত্ত্বিক শুনায়। বিষয়টা হলো, ওগুলো বলবার একটা ভঙ্গি কেউ কেউ এমনভাবে রপ্ত করেছেন এবং জনজীবনের যে বাস্তবতা-তা বিশ্লেষণের ভঙ্গিকে এমনভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা আমাদের কাছে ম্যাজিক্যাল মনে হয়। কিছু লোক ইউরোপীয় সাহিত্যের অর্থে এরকম বিবিধ ধরনের সজ্ঞার্থ, কায়দা-কৌশল তকমা লাগিয়ে খুব মজা পায়। আর মার্কেজ তো একটি জায়গায় বলেছেন, ‘আমার লেখা নিখাদ বাস্তব।’
একটা কথা বললেন যে ইউরোপীয় সাহিত্য। সেটা পেয়ে বা এনে আমরা কি নিজেদের মতো ভাবতেছি?
ওইটা হুবহুকরণ করতেছি। নিজেদের মতো করতে পারলে আমাদের অনেক কিছুই হতো।
ওই তত্ত্ব এনে নিজেদের মতো ভাবা?
না। ইউরোপ ইউরোপ থাক। ‘পান্ডব পান্ডব থাক। কৌরব কৌরব থাক।’ সে তার মতো থাক, আমি আমার মতো থাকি। তার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাকে আমার ভাষায় উপযুক্ত করা, জনজীবনের সাথে উপযুক্ত করা নিরর্থক। আমি লিখবো সেটাই, আমার জয়নুল যেমন ছবি আঁকেন, আমার কৃষক, আমার মাঝির দেহভঙ্গি যেমন। আমি লিখবো বাংলা ভাষায় অথচ সকল কায়দা-কানুন ইউরোপীয়, সেটি কোনো শিল্প হতে পারে না। সেটি কোনো সম্মানজনক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকের কাজ হতে পারে না।
এবার আমাদের নিকটতম সময়ে আসি। আপনি যে সময়টায় লিখছেন, এখন কিন্তু আপনার নিকটবর্তী আরো একটা সময় যাচ্ছে। অনুজরা লিখছে, এই সামান্যটুকু সময়ে কথাসাহিত্যের কোনো বদল চোখে পড়ছে কি না?
সেটা আলাদা করে পার্থক্য নিরূপণ করা আমার কাজ না। তবে নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন গদ্য লিখতে শুরু করেছিলাম। সে তুলনায় আজকে যারা গদ্য লিখতে শুরু করেছেন তাদের বলবার ভঙ্গি, বা তাদের শব্দ- আমাদের তুলনায় খানিকটা বদলে গেছে। এটা সময়ের বাস্তবতা বদলে গেছে বলেই তাদেরটা বদলে গেছে। কিন্তু মোটাদাগে কোনো পরিবর্তনের কথা বলেন, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি।