সত্যমিথ্যার হুমায়ূন আহমেদ
জাহেদ সরওয়ার
🕐 ৬:৫২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৯, ২০১৮
সার্বিকভাবে হুমায়ূন আহমেদের একটা চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে, যাকে আমরা বলি কিংবদন্তি। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজস্ব পাঠক বলয়ে এক রকম আবার সাধারণ মানুষ বা সমালোচকদের চোখে আরেক রকম। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটা সত্য বা কোনটা দরকারি? গণরুচি খুব বাজে জিনিস। লোকজন বলছে বা জনগণ বলছে হুমায়ূন আহমেদ এইরকম, এটা তার সম্পর্কে কোনো বিচারই হতে পারে না।
জগতের সব মানুষই প্রায় তাদের মনগড়া, বলা যায় একটা মিথের ঘোরের ভেতর চলে, তার তৈরি করা স্বপ্ন, নৈতিকতা ও বিচারবোধ সেই মিথকে কেন্দ্র করে। সেটা পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। আসল হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের, হুমায়ূন কিছুটা দর্শকেরও হয়তো। কারণ হুমায়ূন কোনো রাজনৈতিক নেতা নন। তাকে আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে তার সাহিত্য। তার সৃষ্ট চরিত্রসমূহ যেমন মোটাদাগে হিমু, মিসির আলী বা অন্যান্য চরিত্রগুলো যেগুলো তার নিজস্ব ভাষার ভেতর দিয়ে এখনো সাহিত্যের একশ্রেণির পাঠকদের আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। আর তার লেখ্য ভাষা সম্পর্কে একথা বহুবার আলোচিত হয়েছে যে তিনি এমন একটা ভাষাভঙ্গি তৈরি করেছিলেন যেটা ছিল গতিশীল। তাই অনেক পাঠককেই বলতে শোনা যায় তার লেখা একবার ধরলে শেষ না করে ছাড়া যায় না।
আমার মনে হয় লেখকের সত্যসার সেটাই। পাঠককে টেনে রাখার মতো একটা ভাষার উদ্ভাবন। সাহিত্যের আঙ্গিক ব্যবহারে আমি মনে করি তিনি সচেতনভাবেই এন্টিডায়লগ, মন্তাজ ও কিনো আইয়ের ব্যবহার করতেন। এসব যে তার আগে ব্যবহার হতো না তা না। তবে এত সচেতনভাবে নয়। এগুলো মূলত সিনেমাটিক টেকনিক। তিনি প্রচুর সিনেমা দেখতেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নাই। তিনি তো শেষে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। অনেক নাটক নিজে লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন। মূলত, আজকের হুমায়ূন আহমেদ লেখা এবং দেখা দুটি মিলিয়েই।
হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি সম্পর্কে বিচার করতে গেলেই ফরাসি ঔপন্যাসিক জর্জ সিমনের কথা মনে পড়ে যাবে। অবশ্য সেটা ছিল উপন্যাসের স্বর্ণযুগ। শুধু বইলেখা ছাড়া জর্জ সিমন অন্য কোনো কাজ করেন নাই। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন দৈত্য পাওয়া লেখক। কারণ প্রতি সপ্তাহে তিনি একটা একশ পৃষ্ঠার উপন্যাস শেষ করতেন। স্বনামে বেনামে মিলিয়ে তিনি হাজার দেড়েক বই লিখেছিলেন এবং শুধু লেখালেখি করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এই লিখতে পারাটাই লেখকের যোগ্যতা। হুমায়ূন আহমেদও লিখতে পারতেন।
আমি জানি না তিনি কখনো রাইটার্স ব্লগে ভুগছিলেন কি না। সম্ভবত না, তার আত্মচরিত্রমূলক লেখাগুলোতে সে সবের উল্লেখ থাকত যদি তিনি তাতে ভুগতেন। বাংলাদেশি নব্য লেখকরা হুমায়ূন আহমেদ বড় না ছোট লেখক জাতীয় বাজে তর্ক বাদ দিয়ে যদি কীভাবে নিরন্তর লিখতে হয়, সেটা তার লেখার ভেতর থেকে সন্ধান করতেন তাহলে একটা কাজের কাজ হতো। কিন্তু তাদের চায়ের দোকানে তুফান জাতীয় মানসিকতা সেটা করতে দেবে কেন? তারা একজন সাহিত্যিককেও তার লেখালেখির জগৎ থেকে টেনেহিঁচড়ে নোংরা ঘিঞ্জি চায়ের দোকানের কোণায় টেনে এনে- তিনি কাকে বিয়ে করেছেন, কার সাথে প্রেম করেছেন জাতীয় মুখরোচক আড্ডাতেই সময় অতিবাহিত করবেন।
জর্জ সিমনের মতো শুধু লিখে তিনি জীবন ধারণ করতে পারেন নাই। তাই তাকে নাটকের দিকে সিনেমার দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। যদিও আমি জানি না একথা গবেষণালব্ধ কি না। ধারণা করি, চলচ্চিত্র পরিচালনার যেই ঝামেলা বা নাটক নির্মাণের যে ঝামেলা সেটা একজন নিভৃতচারী লেখকের জন্য সুখদায়ক নয়। লেখক একটা নিস্তরঙ্গ পরিবেশ পছন্দ করবেন কারণ অধিক ব্যস্ততা তাকে তরঙ্গায়িত করে। লেখকের যেই নিজস্ব ওয়েব সিস্টেম তাতে আঘাত করলে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটতে বাধ্য। কিন্তু শুধু লিখে বাংলাদেশি পাঠক সমাজে যেখানে বইয়ের কোনো নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী বা কোনো বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠে নাই সেখানে বাঁচা অসম্ভব।
সারা দুনিয়ার বইয়ের ব্যাপক বাজার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। একটা নতুন উপন্যাস লিখতে পারলে ইংরেজি ভাষী একজন লেখক কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার পাঠক পেয়ে যাচ্ছেন। তার বইয়ের কপিরাইট, সেটা সাথে সাথে চলচ্চিত্রের জন্যও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তিনি নিভৃতে বসে লিখতে পারছেন কিন্তু সেটা এখানে কল্পনা করাও বাতুলতা। এখানে ব্যাপারটা এমন যে লিখেছেন তো মরেছেন। এইরকম এক উষর পরিবেশে তিনি প্রায় শ’দেড়েক বা তার কিছু কমবেশি বই লিখেছিলেন সেটা শুধুই লেখালেখি করে সম্ভব নাও হতে পারত।
একটা নিরন্তর পেছনমুখী ভৌতিক সমাজের যেই গণবিচারি হুমায়ূন আহমেদ সেটা আসল হুমায়ূন আহমেদ নয়। সেটা বলে তিনি নাটুরে ছিলেন, তিনি অনৈতিক ছিলেন, তিনি কন্যার বয়সী নারীকে বিয়ে করেছেন, যার সংসার ভেঙে গেছে। এই হুমায়ূন আহমেদ আমাদের না। এই বিচার নিষ্ঠুর, এই বিচার নোংরা পেছনমুখী মিথিক্যাল সমাজের
আমাদের হুমায়ূন আহমেদ তিনি যিনি নিরন্তর সৃজনশীল। যিনি বাংলাদেশের লেখালেখির জগতে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন, যিনি লেখালেখির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিবেদিত ছিলেন। যিনি প্রমাণ করেছিলেন লেখালেখি আর অধ্যাপনা একসাথে চলে না। লেখালেখি সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভু এক পেশা। নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেলে দিতে না পারলে, স্বপ্নের অনিশ্চয়তার ডুবিয়ে দিতে না পারলে লেখালেখির জগতে অদ্বিতীয় হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তার সব লেখা ঘেঁটে আজকের তরুণদের আসলে সেটাই বের করা উচিত যে কী সেই অপার রহস্য যা হুমায়ূনে নিহিত ছিল। এবং এখানেই তার লেখক হওয়া বা দেশীয় সাহিত্যের বেঁচে থাকাও নিহিত। মিথিক্যাল সমাজের হুমায়ূন আমাদের নয়, সৃজনশীল হুমায়ূন আমাদের।