অভিযাত্রীর সীমান্ত অভিযান
পর্ব– ১
মো: ইমাম হোসেন, অভিযাত্রী
🕐 ৩:১০ অপরাহ্ণ, জুন ০৮, ২০২১
অভিযাত্রীর অন্যতম একটি ইভেন্ট বর্ডার ট্রিপ। প্রথম যখন এই বর্ডার ট্রিপ শুরু হয়েছিলো তার নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘ফিরবো না এইবারে’। বর্ডার ট্রিপের উদ্দেশ্য দেশের মানচিত্র ধরে সেইসব প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা, যেখানকার রূপ, লাবণ্য দেখতে কেউ যায় না সচরাচর। এই শহরের যান্ত্রিকতা ভুলে একদম প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া। হেঁটে, নৌকা করে, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ানো।
আমরা চাই এক সময় দেশের পুরো মানচিত্রটা আমাদের ঘোরা হয়ে যাবে। আমাদেরকেই শেষ করতে হবে ব্যাপারটা একদমই তেমন নয়। আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের এই উদ্যোগ দেখে অবশ্যই এগিয়ে আসবে এবং তারাও মাটির ঘ্রাণ নিতে, ঘাসের ডগার উপর জমে থাকা শিশির বিন্দুতে পা ভেজাতে ছুটে যাবে নিভৃত পল্লীগ্রামে। যেখানকার মানুষদের গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার সার্টিফিকেট হয়তো কম আছে, কিন্তু তারা আমাদের থেকে ঢের আগে সভ্য হয়েছে, তাদের মানসিকতা এই সভ্য শহরের উঁচু দালানকোঠায় বসবাস করা মানুষদের থেকে অনেক উন্নত।
অভিযাত্রীর শেষ বর্ডার ট্রিপের পর কোনোভাবেই সময় মিলছে না। ব্যস্ততা, রাজনৈতিক উত্তেজনা, করোনা লকডাউন শেষে অভিযাত্রী শেষমেশ তৃতীয় বর্ডার ট্রিপ আয়োজন করছে - এমন একটা ফোনকল যখন আমার কাছে আসলো তখন আমি কুষ্টিয়ায়। মনের মধ্যে দারুণ একটা উত্তেজনা নিয়ে ঢাকা ফিরছি। বর্ডার ট্রিপ আমার কাছে একটা দারুণ পাওয়া। মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার একটা দারুণ সুযোগ। প্রথম দুই বর্ডার ট্রিপ হয়েছিলো হেঁটে আর এবার হবে সাইকেলে।
প্রথম বর্ডার ট্রিপ শুরু হয়েছিলো সিলেটের জাফলং থেকে। জাফলং থেকে শুরু করে শেষ হয়েছিলো জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার পাথরের চর বাজারে৷ আসাম সীমান্ত ঘেঁষা জিনজিরাম নদীর পারের ছোট্ট বাজার পাথরের চর। পথরের চর থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বর্ডার ট্রিপ শেষ হয়েছিলো কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামাড়ি উপজেলার সালজানি নদীর পাড়ের শিলকুড়িতে। এবছর ভুরুঙ্গামাড়ি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে।
দেশের সীমান্ত ঘেঁষে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া। বর্ডার ট্রিপের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই ট্রিপে সবার সব কিছুই নিজের করতে হয়, নিজের সব কিছু নিজেকে বহন করতে হয়। নিজেকে চেনা ও জানার বড় একটা সুযোগ বর্ডার ট্রিপ বা সীমান্ত অভিযান।
গত দুই অভিযান ছিল পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে, জমির আইল আর বাড়ির উঠোন পেরিয়ে, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে।
এবছর সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা থেকে ১৫ তারিখ রাতে রওনা হয়ে ১৬ তারিখ সকালে ভুরুঙ্গামাড়ি পৌঁছে সাইকেলে এবারের অভিযান শুরু হবে।
আগের দুই বছর বর্ডার ট্রিপে অংশ নিয়েছিলো ১০ জন অভিযাত্রী। এবারও ১০ জন্য অংশ নিলেও শেষ অবধি মঞ্জুর ভাইয়া, বেগ ভাইয়া আর একদম শেষ দিন হাফিজ ভাইয়া যেতে পারলেন না ব্যস্ততার কারণে।
নিশাত আপু, ইউসুফ, দিদার ভাই, কনক দা, এপি আপু, শামীম ভাই আর আমি, এই আমাদের সাতজনের টিম।
১৫ তারিখ রাত ৯.০০ টার সময় আমাদের বাস। সব কাজ শেষ করে বাসায় এসে পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৬.০০ টার সময়। রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে ঘড়ির কাঁটায় ৬.৫৫। নির্ধারিত বাস কাউন্টারে পৌঁছানোর সাথে সাথেই পিচ্চির ফোন। গত বর্ডার ট্রিপে পিচ্চি আমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিলো, এবার অফিসের কারণে আর সম্ভব হয়নি। কথা ছিল ওর গিফট করা বাংলাদেশের টি-শার্ট পরে একটা পুরোদিন সাইকেল চালাবো। শেষ অবধি সেটাও সম্ভব হয়নি। বরং শেষে শুনতে হয়েছে, ‘এই শোনেন, এখন শাবানা স্টাইলে কান্নাকাটি শুরু করবেন না কিন্তু!’ আমি হেসেই শেষ...
বাস আসলো ৯.৩০ মিনিটে। তার আগে আমাদের বিদায় জানাতে গাবতলিতে হাজির হাফিজ ভাইয়া, সোহাগ ভাইয়া, নওশীন আর লিছা। এপি আপুর রান্না করা দূর্দান্ত নেহারি আর রুটি খাওয়া হয়েছে। হাফিজ ভাইয়া আমাদের পানি, ড্রাই কেক, পাউরুটি দিলেন রাস্তায় খাওয়ার জন্য। বাসের ছাদে সাইকেল তুলে, বেঁধে, বিদায়ী সেল্ফি তুলে বাস ছাড়তে ছাড়তে ১০.৩০ পার হলো।
উত্তরে শীত জেঁকে বসেছে। সে অনুযায়ী যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছি। রাস্তায় বেশ জ্যাম, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সাভারের দিকে। গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, আর রাজ্যের ক্লান্তি আমাকে ঘুমের দেশে ঠেলে দিচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেলো, সবাই নামছে গাড়ি থেকে, এখন বেশ শীত শীত লাগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ফুড ভিলেজে চলে এসেছি। কিছু সময়েই ভুল ভাঙলো, চাকা পাঙ্কচার হয়েছে। নিচে নেমে আরও বেশি অবাক হলাম যখন দেখলাম রাত ৩.০০ বাজে অথচ আমরা মাত্র কালিয়াকৈরের মধ্যে, এখনো টাঙ্গাইল পৌঁছাইনি।
ঘণ্টাখানেক পরে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। বাসে উঠে আবার ঘুম, সকাল ৭.০০ টার সময় গাড়ি থেমেছে ফুড ভিলেজে, ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে। খিচুড়ি, পরোটা, মুরগি, দই, ডিম, চা সবই খেলাম কিন্তু কেমন যেন আত্মতৃপ্তি পাওয়া গেলো না। এর মধ্যেই বুঝে গিয়েছি আমাদের ভুরুঙ্গামাড়ি পৌঁছাতে বেশ লেট হবে। সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া হয়ে রংপুর মহাসড়কটি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীতকরণ চলছে। পুরো রাস্তা জুড়েই একটা কনস্ট্রাকশান সাইড। সবচেয়ে বেশি জ্যামে আটকালাম বগুড়ার মহাস্থানে।
২
বেলা ১১.৩৫ বাজে যখন গোবিন্দগঞ্জ পার হচ্ছি। বছর তিনেক আগে আমি আর রাফা নোমান ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্টে কাজ করতে এদিকে এসেছিলাম। দারুণ একটা সময় ছিল তখন। বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে কেমন স্মৃতিকাতর হচ্ছি। বাজারটা এখনো তেমনই আছে।
আছরের আযানের কিছু সময় আগেই কুড়িগ্রাম শহরে এসে গাড়ি থামলো। দ্বিতীয়বারের মতো এই শহরে এলাম। শহরটা বেশ আগে থেকেই আমার পছন্দের। এই শহরের অলিগলি আর মানুষগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মায়া আছে, যে মায়া আমায় ভীষণভাবে টানে।
এই শহরে আমার বেশ কিছু পরিচিত মানুষ আছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ ভক্ত তাদের। ফোন করলাম তাদের, এখন অভিযোগের পালা। আমি কেন আগে বললাম না কুড়িগ্রাম থামবো।
কথা বলতে বলতেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে ভুরুঙ্গামাড়ির দিকে। আমার কেমন অসহায় লাগছে, বারবার মনে হচ্ছে কী যেন ফেলে যাচ্ছি এই ছোট্ট শহরে। বাড়ি, বাগান, উঠোন শেষমেশ যখন ধরোলা নদীর বুকের উপর দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, নদীর ভারী বাতাস আমায় স্পর্শ করছে তখন খেয়াল করলাম, কখন জানি চোখের কোণে পানি এসে জমেছে, একটা টানা দীর্ঘশ্বাস আমার বুকের ভেতর থেকে বেরোনোর জন্য কতটা ছটফট করছে।
মায়া বড্ড খারাপ...
বিকেলের শেষ ভাগ। আমাদের গাড়ি এসে থেমেছে ভুরুঙ্গামাড়ি। যে গাড়ি ভুরুঙ্গামাড়ি পৌঁছানোর কথা ছিল ভোরবেলা, সেটা পৌঁছালো সন্ধ্যায়। টানা ২১ ঘণ্টার বাস জার্নি। এখন রাত সুতরাং রাতে ভুরুঙ্গামাড়িতেই থাকতে হবে। প্ল্যান ছিল, যদি আজ ভোরে ভুরুঙ্গামাড়ি পৌঁছাতে পারতাম তাহলে আজ রাতে লালমনিরহাট সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কোনো গ্রামে ক্যাম্প করতাম।
যেহেতু আমরা পুরো একদিন জ্যামে শেষ করেছি তাই আমাদের ভুরুঙ্গামাড়িতে রাতে থাকতে হবে।
আগে থেকে প্ল্যান না থাকায় আমাদের ঢাকায় যোগাযোগ করতে হলো রাতে থাকার ব্যবস্থার জন্য।
আমাদের থাকার আয়োজন হলো ভুরুঙ্গামাড়ির জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে। ভুরুঙ্গামাড়ির এসিল্যান্ড দারুণ একজন মানুষ, তিনিই আমাদের থাকার আয়োজন করেছেন।
রাত হয়েছে, ফ্রেশ হয়ে খেতে বেরুলাম। সারাদিন খাওয়া বলতে ড্রাই ফুড আর হাফিজ ভাইয়ার দেওয়া পাউরুটি, ড্রাই কেক।
উপজেলা অফিস সহকারী আমাদের রাতের খাবারের জায়গা দেখিয়ে দিলেন। রাতের খাবারটা বেশ দারুণ হলো। খাওয়া শেষে হাঁটতে বেরুলাম। বছর দু'য়েক আগে এই ভুরুঙ্গামাড়ি থেকেই শেষ করেছিলাম সেবারের উত্তরের অভিযান। উপজেলা হিসেবে ভুরুঙ্গামাড়ি বেশ বড়, ব্যবসা জমজমাট। এখানে মূলত আড়ৎ ব্যবসার প্রাধান্য দেখা গেলো।
ভুরুঙ্গামাড়ির বুক চিরে বয়ে গেছে দুধকুমারসহ বেশ কিছু নদ-নদী। প্রতি বর্ষায় দু'কূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ফেলে যায় পলি। যে পলি সেখানকার উৎপাদিত ফসলের ব্যাপক ফলনে সাহায্য করে, যা মাঠ জুড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ডাকবাংলোয় ফিরে এসে আমি আর ইউসুফ বসলাম ম্যাপ নিয়ে। যেহেতু আমরা একদিন পিছিয়ে আছি সেহেতু আমাদের প্ল্যান করতে হবে নতুন করে। সবাই ব্যালকনিতে আড্ডা দিচ্ছে। আগের প্ল্যান সব বদলে ঠিক করলাম আগামীকাল আমরা লালমনিরহাট সদরের থেকেও কিছুটা এগিয়ে যাবো।
এবার আমাদের ইচ্ছে লালমনিরহাট - নীলফামারি - চিলাহাটি - বাংলাবান্ধা - তেতুলিয়া হয়ে পঞ্চগড় গিয়ে শেষ করা। আজ সারাদিন নষ্ট হলো, এক কি:মি:ও চালানো হয়নি। জানি না আমরা এবার পঞ্চগড় যেতে পারবো কি না। অভিযাত্রী কখনো টার্গেটের পিছনে ছুটতে চায় না। আমরা আমাদের মতো ঘুরতে চাই, দেখতে চাই, জানতে চাই, শিখতে চাই। এর মধ্যেই নিশু আপুর থেকে নির্দেশনা আসলো ভোর ৫.৪৫ রিপোর্টিং টাইম।
৩
সরকার এখন এই অঞ্চলের ডাকবাংলোগুলো বেশ আধুনিক করে নির্মাণ করেছে। এই অঞ্চলে প্রতিবছর বন্যা হয়, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, দুধকুমারসহ বেশ কিছু নদী এবং আসাম, দার্জিলিং, সিকিম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এই বন্যার প্রধান কারণ।
বন্যার কারণে প্রতিবছর বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো এই এলাকায় থেকে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর একটা বড় কারণ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
আরাম করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আমার পাশে শামীম ভাই।
সকাল থেকে আমরা বর্ডার ধরে এগোতে থাকবো লালমনিরহাটের দিকে।
সবকিছু পিচ্চিকে বলতে বলতে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম।
শুভরাত্রি, ভুরুঙ্গামাড়ি...
মো: ইমাম হোসেন, অভিযাত্রী