ছয় মামলা শোন অ্যারেস্ট
জামিন হলেও মুক্তি পাচ্ছেন না খালেদা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫০ অপরাহ্ণ, মে ১৬, ২০১৮
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
গতকাল বুধবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই রায় দেন।
খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক আপিল করেছিল। দুটি আপিলই গতকাল খারিজ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ফলে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল রইল। আদেশে আপিল বিভাগ বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে পেপারবুক প্রস্তুত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চকে আপিল (দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল) আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন বহাল থাকলেও আরও কয়েকটি মামলায় তাকে জামিন নিতে হবে। সে জন্য তার কারামুক্তিতে কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের পৃথক আপিলের ওপর শুনানি শেষে ৯ মে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য ১৫ মে দিন রেখেছিলেন। গত ১৫ মে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আরও অধিকতর যুক্তিতর্ক করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। পরে তার যুক্তিতর্ক শুনে গতকাল রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেন আপিল বিভাগ। মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫। বয়স ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আদালত তাকে এই দণ্ডাদেশ দেন। এরপর থেকে খালেদা জিয়া নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। রায়ের পর আপিল করে জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। শুনানি নিয়ে গত ১২ মার্চ হাইকোর্ট খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন। এই জামিনের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল করে, যা আপিল বিভাগ মঞ্জুর করেন। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিনও স্থগিত হয়। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা, যা সেদিন চেম্বার বিচারপতির আদালতে ওঠে। আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এর ধারাবাহিকতায় ৮ ও ৯ মে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে দুদক, রাষ্ট্রপক্ষ ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ১৫ মে অ্যাটর্নি জেনারেল ফের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
খালেদার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আপিল বিভাগের রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, জামিন পেলেও মুক্তিতে কিছুটা বাধা আছে। কারণ সরকার নানা কৌশলে চেষ্টা করবে তার মুক্তিটা বিলম্বিত করার জন্য। নিম্ন আদালতের কতগুলো মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। সে মামলাগুলোয় তার জন্য আমাদের জামিন নিতে হবে। সেই জামিন নিতে যতটুকু সময় লাগে সেই সময়টুকু পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে সময় আপিল বিভাগ দিয়েছেন তা যথেষ্ট কি না- এ প্রশ্নের জবাবে মওদুদ আহমদ বলেন, শুনানি শুরু হলে তখন বোঝা যাবে। শুনানির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তখন বোঝা যাবে কতদিন লাগবে। এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।
আর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে খালেদার আপিল নিষ্পত্তি করতে কতটুকু প্রস্তুত জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, উচ্চতর আদালতের নির্দেশ। এটা অবশ্যই আমাদের নিষ্পত্তি করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতের কাছে এটা আমরা নিবেদন করব যে, আমরা আপিল শুনানি শুরু করার জন্য প্রস্তুত আছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুতি নেবে রাষ্ট্রপক্ষ।
খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন কবে থেকে কার্যকর হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে দিন হাইকোর্ট ডিভিশন তাকে জামিন দিয়েছিলেন চার মাসের গণনা সেই দিন থেকে শুরু হয়েছে। তবে আপিল বিভাগে যে কয়দিন স্থগিত ছিল চার মাস থেকে তা বাদ যাবে।
উল্লেখ, এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এই মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশীদ। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এ অভিযোগ গঠন করেন।
দলবল দেখে আদেশ দিই না : প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, দলবল দেখে আমরা আদেশ দিই না। খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ (শর্ট অর্ডার) চাইতে গেলে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি এমন মন্তব্য করেন। রায় ঘোষণার পর গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বহালের সংক্ষিপ্ত রায় চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। তখন এ জে মোহাম্মদ আলীর আবেদন নাকচ করে দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
আদালত বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশ দেওয়ার বিধান আপিল বিভাগের রুলসে নেই। তবে তাড়াতাড়ি জামিনের রায় প্রকাশ করা হবে বলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীকে আশ্বস্ত করা হয়।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপত্তি জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া তো আরও কয়েকটি মামলায় শোন অ্যারেস্ট আছেন। এছাড়া আপিল বিভাগ থেকে এ ধরনের শর্ট অর্ডার দেওয়ার নজির নেই। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের রুলসে শর্ট অর্ডার দেওয়ার বিধান আছে।
তখন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, হাইকোর্টের বিধান কি আমাদের (আপিল বিভাগের) জন্য মানা বাধ্যতামূলক? এ ধরনের শর্ট অর্ডার দেওয়ার নজির নেই। জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি তা বলছি না। আপনারা চাইলে তা দিতে পারেন।
আরেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, আপনি গুরুতর আপত্তিকর কথা বলেছেন। আপনি আমাদের ফোর্স (জোর) করতে পারেন না। আপনারা ভুলে যান যে, কোর্টে আপনারা আইনজীবী। অফিসার অব দ্য কোর্ট। কোনো দলের লোক নন।
জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী তার মন্তব্যের জন্য আদালতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, ব্যারিস্টার নওশাদ জামির প্রমুখ।
কয়টি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট খালেদা
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আপিল বিভাগ থেকে জিয়া অরফানেজ মামলায় গতকাল জামিন পেলেও এখনই জেল থেকে তার মুক্তি মিলছে না। কেননা এখনো বেশ কয়েকটি মামলায় তাকে অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। এসব মামলায় জামিন পেলেই তার মুক্তি মিলবে। আর কয়টি মামলায় জামিন প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই তার আইনজীবীদের।
গতকাল বুধবার এ বিষয়ে জানতে বিএনপি চেয়ারপারসনের বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিভিন্ন রকম তথ্য দিচ্ছেন।
খালেদা জিয়ার মামলার সংখ্যা সম্পর্কে সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে তিনটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শ্যোন অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার দেখানো) হয়েছে। এর মধ্যে দুটি কুমিল্লা এবং একটি নড়াইলে। নড়াইলের মামলাটি বেইলেবল অফেন্স (জামিনযোগ্য অপরাধ) এবং অন্যান্য মামলায়ও জামিন হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
একই বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, তাকে এখনো কিছু মামলায় জামিন নিতে হবে। এর মধ্যে কুমিল্লায় তিনটি, নড়াইলে একটি এবং ঢাকায় দুটি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় জামিন বহাল রাখা হলেও এখনই তিনি কারামুক্ত হতে পারবেন না। তাকে আরও কিছু মামলায় মিথ্যা আসামি করা হয়েছে, যাতে তাকে আরও কিছুদিন জেলে রাখা যায়। তাই আমাদের এই মামলাগুলোয় জামিন নিতে হবে। এখন আইনি প্রক্রিয়ায় আমাদের এগোতে হবে।
খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে বিভিন্ন মামলার ফাইলিং ল’ইয়ার ও বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ৩৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু দুটি মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (হাজিরা পরোয়ানা) রয়েছে। এ সংখ্যা আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি। কেননা, খালেদা জিয়ার মামলার সব ফাইল আমার কাছেই থাকে। এখন সরকার বাধা সৃষ্টি না করলে খালেদা জিয়ার এসব মামলাতেও তার জামিনে মুক্তিতে বাধা থাকবে না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খালেদা জিয়ার কারামুক্তিতে আরও ৬ মামলায় জামিন পেতে হবে। এর মধ্যে ৪ মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট আছে, এগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। কুমিল্লা, নড়াইল এবং ঢাকাতে এ মামলাগুলো রয়েছে। তার বিরুদ্ধে সর্বমোট মামলা রয়েছে ৩৬টি।