ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঝুলে গেল খালেদার মুক্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৩, ২০১৯

নিম্ন আদালতে দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর ২০ মাস কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৭৪ বছর বয়সী এই নেতা ডায়াবেটিস, আর্থাইটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও দাঁতের সমস্যায় ভুগছেন। গত এপ্রিল থেকে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন খালেদার শারীরিক অবস্থা ভালো হয়নি বলে মনে করছে বিএনপি। দেশে-বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য তৎপরতা শুরু করেছে দলটির নেতারা। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষিও চলছে বিএনপির। সরকার এ ব্যাপারে আগের চেয়ে নমনীয়তাও দেখাচ্ছে। তবে শেষপর্যন্ত এবারের তৎপরতার ফলাফলও শূন্য হতে পারে। কেননা, প্যারোল ইস্যুতে ঝুলে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার মুক্তি।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় বিএনপি প্রধানের ১৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। হাইকোর্টে তার জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে। জামিনের ব্যাপারে খুব শিগগিরই আপিল বিভাগে যাবেন তার আইনজীবীরা। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বয়স ও শারীরিক অবস্থার বিবেচনায় এ ধরনের মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জামিনের এ বিষয়টা আদালতের ব্যাপার হলেও এর পেছনে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার রয়েছে। সরকার না চাইলে আদালতের কিছু করার নেই। এ জন্য আদালতে যাওয়ার আগে বিএনপি চাইছে সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে।

এরই অংশ হিসেবে মঙ্গল ও বুধবার দুই দফায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাতজন সংসদ সদস্য বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। তারা খালেদা জিয়ার ‘অবনতি হওয়া’ শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে মানবিক দিক বিবেচনায় তার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। প্রথম দিন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে তিন জন সংসদ সদস্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে জানান, জামিনে মুক্তি পেলে চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য অবশ্যই চেয়ারপারসন বিদেশে চিকিৎসা করতে যাবেন। উনি আজকে জামিন পেলে কালকেই বিদেশ যাবেন। উনি যদি আজকে জামিন পান, প্রথম অগ্রাধিকার হবে উনার চিকিৎসা।

হারুনুর রশিদ বলেন, ‘এমপি হওয়ার পর ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি। আমরা ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিতে গিয়েছিলাম। যা দেখলাম তা খুবই অমানবিক। শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। ম্যাডাম এতটাই অসুস্থ, নিজে মুখে তুলে খেতেও পারেন না।’

এর পরদিন জি এম সিরাজের নেতৃত্বে চার সাংসদ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদ নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে আমাদের সবিনয় অনুরোধ, আপনি খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আপনি আমলাতান্ত্রিক পরামর্শ না নিয়ে দয়া করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আমাদের নেত্রীকে ছেড়ে দিন, জামিনের ব্যবস্থা করে দিন।’

বিএনপি নেতারা মনে করেন, দলের চেয়ারপারসনকে কারাগার থেকে মুক্ত করা এখন বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা। বারবার আইনগত পথে এগোলেও শেষপর্যন্ত তার জামিন হয়নি। এদিকে ২০ মাসেও খালেদা জিয়ার মুক্তি না হওয়ায় দলের নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশাও বাড়ছে। এ অবস্থায় দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

এর আগে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের পরে গত এপ্রিল মাসে রাজনৈতিক সমঝোতায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টা চাউর হয়। এ নিয়ে বিএনপি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সমঝোতার চেষ্টাও চলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্যারোলের প্রশ্নে জামিনের সমঝোতা ব্যর্থ হয়।

এ দফায় বিএনপির সংসদ সদস্য ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হারুনুর রশিদ কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত কাজে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সাক্ষাতে তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানানোর জন্য কাদেরকে বলেন। গত পরশু সচিবালয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে হারুনুর রশিদ ফের দেখা করেন।

এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, জামিন পেলে খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন, এ কথা বিএনপির যে সদস্য বলেছেন, তিনি আমার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। আমাকেও একই কথা বলেছেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও জানাতে বলেছিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’ এ সময় ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, অপেক্ষা করুন, গরম খবর আসছে। তার এই গরম খবর খালেদা জিয়ার মুক্তির ইঙ্গিত কি-না তা নিয়ে দিনভর গুঞ্জন চলে।

কিন্তু এ গুঞ্জনের উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে যায় গত পরশু সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে। ওই বৈঠকের সূত্রে গণমাধ্যমে খবর বের হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গে ‘নো কম্প্রোমাইজ’ বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘কোনো উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলবা না। তার (খালেদা জিয়া) বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ নয়।’ তবে বৈঠকের সূত্রের বরাতে প্রধানমন্ত্রীর যে ভাষ্য এসেছে, তা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি নেতাদের অনুরোধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি।

খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সরকারের প্রভাবশালী একটি সূত্র জানায়, আলাপ-আলোচনা, দর কষাকষি, সমঝোতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশ। বিএনপি নেতারা সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে অ্যাপিল করেছেন। সরকার তার মুক্তির বিষয়ে আগের চেয়ে নমনীয়। কিন্তু সরকার চায় প্যারোলে মুক্তির আবেদন করুক বিএনপি চেয়ারপারসন। বিএনপির নেতারা তাদের দলীয় চেয়ারপারসনের জামিনে মুক্তি চাইলে সে ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না সরকার।

এ বিষয়ে সরকারের মনোভাব হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সরকারের কোনো হাত নেই। এটা আদালতের এখতিয়ার। বিচার বিভাগ স্বাধীন। তারা স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে সরকার কোনো সহযোগিতা করবে কি-না এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি তো চাই তারা আন্দোলন করুক। তাদের এক হাজার লোকের একটা ঝটিকা মিছিলও তো দেখলাম না। তাদের নেতানেত্রীরা বলছেন- জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মুক্ত করবেন, আমরাও বলছি আন্দোলন করুন। সভা সমাবেশের তো অনুমতি পাচ্ছেন।’

আদালত যদি জামিন দেয়, চিকিৎসকরা যদি খালেদাকে বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন, তখনই সরকার বিষয়টি দেখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, খালেদা জিয়া রাজবন্দি নন, তার মুক্তি সরকারের এখতিয়ারে নেই। এটা আদালতের এখতিয়ার।

সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথে এগোলেও মাঠের আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে খালেদার মুক্তির কথাও ভাবছে বিএনপি। সমঝোতা, আইনি লড়াই ও আন্দোলন- তিন নীতিতেই এগোতে চায় তারা। বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক মানববন্ধনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়া কারও অনুকম্পায় মুক্ত হবেন না। জামিন পাওয়ার অধিকার ন্যায্য অধিকারে তিনি মুক্ত হবেন। ‘বেআইনি মিথ্যা মামলা’ দিয়ে তাকে আটকে রাখা যাবে না। জনগণ তাদের প্রিয় নেত্রীকে অবশ্যই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বের করে নিয়ে আসবে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য খুব শিগগিরই আপিল বিভাগে আবেদন করবে বিএনপি। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে, বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতা জয়নুল আবেদীন, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির পথ খুলতে আদালতে জামিন আবেদনের বিরোধিতা না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। সরকার একদিকে বলছে, আদালত জামিন দিলে তাদের আপত্তি নেই। অথচ আমরা যখন আদালতে জামিন আবেদন শুনানি করি, তখন সরকার পক্ষ থেকে জোরালোভাবে জামিনের বিরোধিতা করা হয়। যদিও এ ধরনের মামলায় আর কখনও সরকার পক্ষ থেকে এভাবে জোরালো আপত্তি করতে দেখিনি।

সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এখন ১৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন পেলেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

এর আগে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া ১০ বছরের সাজার রায় স্থগিত এবং জামিন চেয়ে গত ১৪ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করেন খালেদা জিয়া। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাত বছরের সাজা ও অর্থদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। এই আপিল গত ৩০ এপ্রিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন হাইকোর্ট।

আপিল শুনানির জন্য গ্রহণের পর জামিন চেয়ে খালেদা জিয়ার আবেদন গত ৩১ জুলাই হাইকোর্টে খারিজ হয়। পরে হাইকোর্টের অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চে এই জামিন আবেদন উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু গত ১১ সেপ্টেম্বর এই জামিন আবেদন ফিরিয়ে নেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এখন আইনজীবীরা ফের আপিল বিভাগে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 
Electronic Paper