নুসরাত থেকে মিন্নি
আড়ালেই প্রভাবশালীরা
মিন্নির জামিন শুনানি ৩০ জুলাই
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৩০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৩, ২০১৯
দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে পুড়ে মরা ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি আর বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারা রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নির ঘটনার ধরন-প্রকরণ এবং চরিত্র আলাদা। এরপরও দুটি পৃথক ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছেন দুজন নারী। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুটি ঘটনারই নেপথ্যে রয়েছে দুটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট; যারা নানাভাবে ঘটনা পরম্পরাকে প্রভাবিত করছে। অথচ দুই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হোতারা রয়ে যাচ্ছে আড়ালেই।
সমাজ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুটি ঘটনার পার্থক্য বিস্তর হলেও দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা যেমন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তেমনি অভিযুক্তদের ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক। দেখা গেছে ঘটনার হোতা হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কও নিবিড়। দুই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ভিন্নদিকে মোড় দেওয়ার জন্য মরিয়া দেখা গেছে দুটি মহলকে। মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর অধ্যক্ষকে বাঁচাতে নুসরাতের বিরুদ্ধে একটি মহলকে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেখা গেছে। আর বরগুনায় রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে হত্যার পর প্রত্যক্ষ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলার বদলে রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে ঘটনায় হোতা দাবি করে স্থানীয় একটি মহল যথারীতি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সংঘটিত করেছে। সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় এমপিপুত্র, যার নামে রিফাতের হত্যাকারী নয়ন বন্ডের সঙ্গে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করায় গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। চিকিৎসারত অবস্থায় পাঁচ দিন পর মারা গিয়েছিলেন নুসরাত। নুসরাতের মৃত্যুর পর যেসব তথ্য প্রকাশ্যে আসে তা ছিল ভয়ঙ্কর। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর সেটাকে আত্মহত্যাচেষ্টা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল পুলিশ। হত্যাকারীদের বাঁচাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন সব দোষ উল্টো নুসরাতের কাঁধে চাপাতে। কিন্তু মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন নুসরাত।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে উঠে আসে রোমহর্ষক সব তথ্য। ঘটনার হুকুমদাতা অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ছাড়াও পিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে আসামি হন সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমসহ ১৬ জন। শুধু তাই নয় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেমও এখন কারাগারে রয়েছেন।
বরগুনার নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা আখতার মিন্নির ঘটনা নুসরাতের ঘটনা থেকে একেবারেই আলাদা হলেও এখানে সক্রিয় প্রভাবশালী চক্রটির তৎপরতা একেবারেই মিলে যায় নুসরাত হত্যায় জড়িত সিন্ডিকেটটির তৎপরতার সঙ্গে।
গত ২৬ জুন সকাল বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে রিফাত শরীফকে। তখন তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি হামলাকারীদের থামানোর চেষ্টা করেও সফল হননি। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫ থেকে ৬ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকা ৭ আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও ৭ জনকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড নিহত হয়েছেন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’।
ঘটনার পর থেকে একটি মহল রিফাত শরীফের হত্যায় স্ত্রী মিন্নি জড়িত দাবি করে তাকে গ্রেফতার করাতে মরিয়া হয়ে উঠে। প্রত্যক্ষ খুনি এবং তাদের মদদদাতাদের থেকে কৌশলে মনোযোগ সরিয়ে সব মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় মিন্নির ওপর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের ভিডিও ছড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় মিন্নিকে। এমনকি মিন্নির ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। এরই মধ্যে রিফাত শরীফের হত্যাকারী নয়ন বন্ডসহ গোটা গ্যাংটির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নাম উঠে এসেছে স্থানীয় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পুত্র সুনাম দেবনাথের নাম। তার নেতৃত্বে সম্প্রতি প্রতিবাদ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখান থেকে রিফাত শরীফ হত্যায় স্ত্রী মিন্নির জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয় এবং পুলিশ কয়েক দিন পর মিন্নিকে গ্রেফতার করে।
এ সিন্ডিকেটটির প্রভাব ও শক্তি এতটাই যে, মিন্নির জন্য আদালতে দাঁড়ানোর মতো কোনো আইনজীবীও পাওয়া যায়নি। মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ইতোমধ্যেই বলেছেন, তার মেয়েকে না ফাঁসিয়ে সঠিক তদন্ত করা হোক। তাহলে রিফাত হত্যার মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে। মামলার এক নম্বর সাক্ষী থেকে আসামিতে পরিণত মিন্নি কয়েক দিন আগে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। মিন্নির বরাত দিয়ে বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর দাবি করেন, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে ও জোরজবরদস্তি করে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে খুনিদের আড়াল করতে আমার মেয়েকে ফাঁসাচ্ছে শম্ভু ও শম্ভুপুত্র সুনাম।
তিনি বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমার মেয়ে কোনোভাবেই জড়িত নয়। ঢাকা থেকে আইনজীবীরা আসবে শুনে নির্যাতন করে তড়িঘড়ি আমার মেয়েকে দিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আমার মেয়েকে গ্রেফতার করে মামলায় জড়ানো হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মাসখানেক আগে একটি মাদকের মামলায় রিফাত শরীফকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন নয়ন বন্ড। এছাড়া, এই হত্যা মামলার আরেক আসামি রিফাত ফরাজীর সাথেও রিফাত শরীফের দ্বন্দ্ব ছিল। কিছুদিন আগে রিফাত ফরাজীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে রিফাত শরীফ- এমন কথাও বলছেন এলাকার বিভিন্নজন। বেশ কিছুদিন আগে বরগুনা শহরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের বাড়ির সামনে একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে যায় রিফাত শরীফ। তখন ওই বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল পার্কিং করাকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যানের স্ত্রীর সাথে রিফাত শরীফের বচসা হয়। এ বিষয়টি হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী এবং রিশান ফরাজী-এই দুই ভাইকে ক্ষুব্ধ করে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। কারণ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের স্ত্রী তাদের খালা। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে রিফাত শরীফ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা- এমন প্রশ্নে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের স্ত্রী খুকি অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করেন।
তিনি দাবি করেন, রিফাত শরীফকে তিনি কখনো দেখেননি, বাকবিতণ্ডা তো দূরের কথা।
এদিকে রিফাত শরীফকে যারা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তারা বরগুনা শহরে সংঘবদ্ধ অপরাধী হিসেবে পরিচিত। বরগুনা শহরে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজী। মাদকের মামলায় এরা বেশ কয়েকবার কারাগারেও গিয়েছিলেন। রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তাহলো এরা কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন?
কিন্তু এ আলোচনা আড়ালে চলে যেতে থাকে যখন নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ গত ১৩ জুলাই, অর্থাৎ ঘটনার ১৮ দিন পরে পুত্রবধূ মিন্নির গ্রেফতারের দাবি তোলেন।
বরগুনায় কর্মরত একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ সংবাদ সম্মেলন করাতে দুলাল শরীফকে নিয়ে বরগুনা প্রেস ক্লাবে এসেছিলেন। দুলাল শরীফ যখন সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন সুনাম দেবনাথ অন্য আরেকটি কক্ষে অবস্থান করেন। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, রাজনৈতিক চাপে পড়ে দুলাল শরীফ সংবাদ সম্মেলনটি করেছেন কিনা।
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার জন্য যারা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ ১৬ জন। বরগুনা শহরে মাদকসহ নানা অপরাধ তৎপরতার সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে, এমন আশংকা থেকেই মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা।
মিন্নির জামিন শুনানি ৩০ জুলাই
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন চেয়ে আবার আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালত আগামী ৩০ জুলাই জামিন শুনানির দিন ধার্য করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান শুনানির জন্য এদিন ধার্য করেন।
এ বিষয়ে মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, ‘সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিন্নির জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিস কেস হিসেবে মিন্নির জামিন শুনানির আবেদন করি। পরে আদালত শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের নথি তলব করে আগামী ৩০ জুলাই মিন্নির জামিন শুনানির দিন নির্ধারণ করেন।’
এর আগে গত সোমবার আদালতে দেওয়া মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার ও তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির আবেদন নামঞ্জুর করেন বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী।
অন্যদিকে এ মামলার অভিযুক্ত হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া কামরুল আহসান সাইমুনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। গতকাল সকালে আবেদনের পর দুপুরে সাইমুনের জামিন আবেদনের শুনানি হয়। পরে শুনানি শেষে আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. ইয়াসিন আরাফাত সাইমুনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন সাইমুনের আইনজীবী গোলাম মোস্তফা কাদের।