ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

২৫ বছর পর শেখ হাসিনার ট্রেনে হামলার রায়

মৃত্যুদণ্ড ৯ যাবজ্জীবন ২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক ও পাবনা প্রতিনিধি
🕐 ১১:১৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৩, ২০১৯

পাবনার ঈশ্বরদীতে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনে গুলি ও বোমা হামলার ঘটনায় করা মামলার রায়ে ৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর ২৫ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১৩ জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. রুস্তম আলী এ আদেশ দেন। ২৫ বছর পর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা হলো।

মামলায় রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৯ আসামির প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ২৫ জনের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। আর ১৩ জনের প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জেলা বিএনপির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক কে এম আখতারুজ্জামান, ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির (স্থগিত কমিটি) সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু (পলাতক), কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মোকলেসুর রহমান ওরফে বাবলু, তার ভাই সাবেক ছাত্রদল নেতা রেজাউল করিম ওরফে শাহিন, অপর ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমান ওরফে পলাশ, বিএনপি নেতা মো. অটল, ঈশ্বরদী পৌর যুবদলের সভাপতি শ্যামল (নূরে মোস্তফা), স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুর রহমান ওরফে শাহীন ও বিএনপির সাবেক নেতা শামসুল আলম।

যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম (পলাতক), আজাদ হোসেন ওরফে খোকন, ইসমাইল হোসেন ওরফে জুয়েল, আলাউদ্দিন বিশ্বাস, শামসুর রহমান, আনিসুর রহমান (পলাতক), আক্কেল আলী, মোহাম্মদ রবি, মোহাম্মদ এনাম, আবুল কাশেম, কালা বাবু, মো. মামুন (পলাতক), মামুন-২ (পলাতক), সেলিম হোসেন, মো. কল্লোল, তুহিন, শাহ আলম ওরফে লিটন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, লাইজু (পলাতক), আব্দুল জব্বার, পলাশ, আবদুল হাকিম, আলমগীর হোসেন, এ কে এম ফিরোজুল ইসলাম ওরফে পায়েল ও আবুল কালাম।

১০ বছর করে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বিএনপি নেতা ও ঈশ্বরদী উপজেলার শাহাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নেফাউর রহমান রাজু, আজমল হোসেন, সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ঈশ্বরদী পৌরসভার বর্তমান কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রদলের সাবেক নেতা মো. রনো (পলাতক), মো. বরকত, চাঁদ আলী (পলাতক), এনামুল কবির, মো. মোক্তার, হাফিজুর রহমান মুকুল, হুমায়ন কবির ওরফে দুলাল (পলাতক), জামরুল (পলাতক), তুহিন বিন সিদ্দিক ও ফজলুর রহমান।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আখতারুজ্জামান রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক আইনের ৩ ধারা মোতাবেক আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেছেন। মামলার মোট ৫২ আসামির মধ্যে গত ২৫ বছরে পাঁচজন মারা গেছেন। বাকি ৪৭ জন দ-প্রাপ্ত হলেন। এদের মধ্যে রায় ঘোষণার সময় ৩২ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তরাঞ্চলে দলীয় কর্মসূচিতে ট্রেনবহর নিয়ে খুলনা থেকে সৈয়দপুর যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশনে ঢোকার সময় ট্রেনবহরকে লক্ষ্য করে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা অতর্কিত হামলা চালায়। ট্রেনে ব্যাপক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে তারা। এ সময় পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য এগিয়ে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করেও সেদিন বোমা হামলা চালানো হয়।

এ ঘটনায় ঈশ্বরদী জিআরপি (রেলওয়ে পুলিশ) থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা ও বর্তমানে ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক (স্থগিত কমিটি) জাকারিয়া পিন্টুসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পরের বছর পুলিশ কোনো সাক্ষী না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র জমা দেয়। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু আদালত সে অভিযোগপত্র গ্রহণ না করে অধিক তদন্তের জন্য মামলাটি সিআইডিতে পাঠান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলাটির পুনঃতদন্ত হয়। ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল পুলিশ ঈশ্বরদীর বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীসহ ৫২ জনের নামে আদালতে আবার অভিযোগপত্র জমা দেয়। গত রোববার আদালতে আসামিদের সাফাই সাক্ষী উপস্থাপনের নির্ধারিত দিন ছিল। ৩০ জন আসামি কোনো সাক্ষী উপস্থাপন না করে আদালতে জামিন আবেদন ও সময় প্রার্থনা করেন। আদালত তাদের প্রার্থনা নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর গত সোমবার উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত বুধবার মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। রায় ঘোষণার আগের দিন গত মঙ্গলবার আরও দুই আসামি আত্মসমর্পণ করেন। তারা হলেন- ঈশ্বরদী পৌরসভার সাবেক মেয়র মোখলেছুর রহমান বাবলু এবং বিএনপি নেতা আব্দুল হাকিম টেনু। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়।

এদিকে এ রায়কে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকেই আদালত এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বিএনপি নেতাকর্মী ও আসামিদের স্বজনরা রায়ের প্রতিবাদে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রায়ের পর আনন্দ মিছিল শুরু করলে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। আদালতে উপস্থিত লোকজন এ সময় আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সেদিন যা ঘটেছিল
হামলার ঘটনার পরদিন (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪, শনিবার) ভোরের কাগজ পত্রিকায় এ নিয়ে ‘শেখ হাসিনার ট্রেনযাত্রায় বাধা গুলি বোমা : আহত অর্ধশত’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাবনার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালানো হয়েছে। ট্রেনযোগে গণসংযোগ কর্মসূচি পালনের একপর্যায়ে খুলনা থেকে ঈশ্বরদী পৌঁছলে এ ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে ঈশ্বরদী স্টেশনে ট্রেনটি প্রবেশের সময় কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয় একটি বগিকে লক্ষ্য করে। ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে কড়া পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষের উদ্দেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতাকালে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। জনসভায় গোলযোগের সময় মাথায় বোমার আঘাত লাগে যুবলীগ কর্মী স্বপনের। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন, নায়েক ফজলুল হক, ঈশ্বরদী থানার পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হন।

ঘটনা নিয়ে তৎকালীন সরকারের প্রেসনোট
১৯৯৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরের কাগজে সরকারি একটি প্রেসনোট ছাপা হয়। এতে শেখ হাসিনার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে বলা হয়, গতকাল বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বহনকারী ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, তার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সরকার জানাতে চায় যে, প্রাথমিক রিপোর্টে বিরোধীদলীয় নেত্রীর এ অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী স্টেশনে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টা আগে পরস্পরবিরোধী কতিপয় রাজনৈতিক দলের উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকরা উল্লিখিত স্টেশন দুটির আশপাশে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় লিপ্ত হয় এবং পটকা বিস্ফোরণ ঘটায়।

 

 
Electronic Paper