ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নার্সিং প্রয়োজন : ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

কাজল রশীদ শাহীন
🕐 ১০:২০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০১৯

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। টেকসই উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নার্সিং, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, ইউজিসির ক্ষমতা, ছাত্ররাজনীতি, ব্যক্তিগত জীবনের তৃপ্তি-অতৃপ্তি, শিক্ষকতার জীবন, লেখালেখি সম্পর্কে বলেছেন খোলা কাগজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল রশীদ শাহীন

আপনি কেমন বাংলাদেশ চান?
কেমন আবার, বঙ্গবন্ধু যেটা বলেছেন, সেই ‘সোনার বাংলাদেশ’ চাই। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্যটাকে অনেক এগিয়ে নিয়েছেন। আমাদের তো এখন আর খাওয়া-পরার সমস্যা নেই। অন্য একটা জায়গায় আমাদের অভাব ছিল, সেটা হলো ভাবমূর্তি-এটাও আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছি। বাইরে গেলে আমরা আজকাল যে ধরনের সম্মান পেয়ে থাকি, আগে কিন্তু তা পেতাম না। এমনকি হজ করতে গিয়েও সম্মান পেয়েছি। অথচ সৌদি আরবের মানুষ তো আগে আমাদের ক্লিনার মনে করত। হজ করতে গিয়ে স্বর্ণের দোকানে ঢুকেছি, কথায় কথায় বিক্রেতা বলল, তোমাদের দেশ তো সাংঘাতিক কিছু। তোমাদের নেত্রী এই করেছে, ওই করেছে।

কিন্তু এই এগুনোর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না...
সে সমস্যা কিছুটা তো আছেই। তবে আওয়ামী লীগ এবার যে মেনিফেস্টো দিয়েছে সেটা কিন্তু আমার খুব পছন্দ। সেখানে তারা শুদ্ধি অভিযানের কথা বলেছেন। জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকটাতেই জিরো টলারেন্স বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত কোনোটাকেই ভালো করে ধরা হচ্ছে না। আমার তো কথা হচ্ছে, ধরতে হবে যে কোনো একটাকে। সেটা হতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করার বিষয়ে। ইদানীং নেত্রীর কর্মকা- অবজারভ করছি। কিছুদিন আগেও আমরা আয়ের বৈষম্য নিয়ে খুব কথা বলতাম। হঠাৎ করে লক্ষ করলাম, কয়েক দিন আগে তিনি বলছেন, এই বৈষম্যটা দূর করতে আমাদের প্রয়াস নিতে হবে। তো এমনিভাবে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছিলাম। নেত্রীও এখন শুদ্ধি অভিযানের কথা বলেছেন। এতে আমি ভীষণ রকম উৎফুল্ল। তবে আমি মনে করি, রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি সামাজিক শুদ্ধি অভিযানও প্রয়োজন। সামাজিক ব্যাধি কিন্তু নিরসন করা প্রয়োজন।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কী হবে?
গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলোও ডেভেলপ করা প্রয়োজন। কারণ অর্থনৈতির উন্নয়টাকে আমরা একটি বিশেষ স্টেজ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। এখন এটাকে টেকসই করতে হলে অন্য ধরনের কাঠামোগত বিন্যাস এবং বিস্তৃতি প্রয়োজন। সেদিক থেকে বলা যায়, আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা একেবারেই করুণ। এটা দিয়ে তো দেশ চলতে পারে না।

বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে...
হ্যাঁ, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। বড় শিল্পগোষ্ঠী তৈরি হলে ছোট শিল্পগুলোকে গিলে খান তারা। অনেকটা বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে গিলে খেয়ে ফেলে। যেভাবে বড় শিল্পগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে তাতে কিছুদিন পর দেখা যাবে নির্দিষ্ট বলয় তৈরি হয়েছে, যে বলয়ের মধ্যে আছে কতিপয় মানুষ আর বাইরে আছে সমাজের বিশাল অংশের মানুষ। বলয়ের ওই গুটিকয় মানুষ সমাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, রাজনীতিটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এমনকি সাধারণ মানুষের রুটি-রুজিও নিয়ন্ত্রণ করবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কিন্তু এমন নিয়ন্ত্রণের বাংলাদেশ নয়। বঙ্গবন্ধু তো নিহত হয়েছেন শোষিতের গণতন্ত্র চেয়ে। তা না করে উনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করে চলতেন, তাহলে তো নিহত হতেন না।

বঙ্গবন্ধু তার মৃত্যুর বিষয়টি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন?
আমি তো মনে করি, বঙ্গবন্ধু নিজেই নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। আশপাশের সুযোগসন্ধানী মানুষকে খেপিয়ে তুলেছিলেন নানাভাবে। শাসক হিসেবে জনগণকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, খেপিয়েছেন আমলাদের। প্রচলিত সেনাবাহিনীর বাইরে গিয়ে সাধারণের সেনাবাহিনী গঠন করার চিন্তা করে খেপিয়েছেন সেনাবাহিনীকে। গ্রামে কো-অপারেটিভস প্রতিষ্ঠা করে খেপিয়েছেন জোতদারদের। এত কিছুর সঙ্গে খেপিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদকে। তো তারা প্রতিশোধপরায়ণ হবে না কেন? বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমার ভাগ্য যদি চিলির সালভাদর আলেন্দের মতো হয়, তারপরও আমি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না। তো শেষ পর্যন্ত উনার ভাগ্যও হলো সালভাদর আলেন্দের মতো।

স্বাধীনতার পর আবার শিক্ষকতায় এসে পুরো মেয়াদ শেষ করলেন?
না, শেষ করিনি। যখন ছাড়লাম তখনো দুই বছর চাকরি পাওনা ছিলাম। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আরও দুই বছর এক্সট্রা পেয়েছিলাম। আমার মতো আরও অনেকেই পেলেন। আবার আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যারা মুক্তিযুদ্ধই করেননি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির অতিরিক্ত দুই বছরও ভোগ করেছেন। এদের সম্পর্কে ভাবলে আমার নিজেরই করুণা হয়। তো যাই হোক, একবার ছুটি নিয়ে এসে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হলাম। পরের বার ছুটি চাইতে গিয়ে মনে হলো, ছুটিটা আমাকে দেওয়া হবে না। রিজাইন দিয়ে দিলাম। তখনো আমার দুই বছরের চাকরি রয়ে গেল।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি তো আপনারই প্রতিষ্ঠা?
ঠিক আমার বলা যাবে না, আমাদের। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি তৈরির একটা প্রেক্ষাপট আছে। ড. আলিমুল্লাহ মিয়া নামে এক ভদ্রলোকের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল আইইউবিএটি। আমি এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকা যায়নি। এরপর মান্নান সাহেবের পিপলস ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত হলাম কিন্তু এখানেও শেষ পর্যন্ত থাকা গেল না। মান্নান সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকার সময় আমি ছিলাম প্রক্টর। তো তারপর আমি ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয় নামে আরেকটা প্রতিষ্ঠান করলাম। এখানেও থাকা হলো না। আমার আর্থিক জোর ছিল না বলে সব জায়গা থেকে লোকজন আমাকে তাড়িয়ে দিল। ওদিকে শক্তি প্রয়োগও করতে পারি না। তারপর নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেখি নিজে কিছু একটা করা যায় কি না।

শিক্ষা কি জন্য, শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত বা শিক্ষা কি করে দিতে হবে-এসব নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ফিলোসফি আছে। কারণ বিদেশে পড়াশুনা করেছি, বিদেশে পড়িয়েছি, দেশেও পড়িয়েছি দীর্ঘদিন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর মনে হলো, সমাজটাকে যদি এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন করা উচিত, যেটা নাকি সমাজটাকে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সাহায্য করবে। সেসব ভেবেই ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিলাম। নার্সিং করলাম বেশ কিছুদিন। শুরুতে আমেরিকান একটা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে জয়েন্টলি ডিগ্রি দেওয়া শুরু করলাম। এটা ছিল ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে। তারপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৩ সালে এসে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করলাম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ১৬-১৭ বছর হয়ে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস করেছি, সেটা উদ্বোধনও হয়েছে।

আপনারা কি নিজস্বক্যাস্পাসে চলে গেছেন?
অবশ্যই, নাইটি নাইন পার্সেন্ট চলে গেছি। ক্লাস, প্র্যাকটিকাল-এগুলো স্থায়ী ক্যাম্পাসেই হচ্ছে। এখন অস্থায়ী ক্যাম্পাসগুলো আস্তে আস্তে ছেড়ে দেব। কারণ সরকারের বিধান আমি লঙ্ঘন করতে চাই না। তবে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, যখন আমি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাচ্ছি না, তখন পত্রিকায় অনেক নিউজ হলো। আর এখন যখন আমি ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছি, তখন এটার ওপর আর কেউ নিউজ করছে না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নে কী রকম ভূমিকা রাখছে?
সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথাও কি মান আছে বলে আপনার মনে হয়? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের পয়সা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষকরা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াচ্ছে। তো শিক্ষকরা যেখানে গিয়ে বেশি পড়াচ্ছে সেখানকার মান তো ভালো হয়েই যেতে পারে!

এখন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ ভালো করছে। এই যেমন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলতে পারি, টাইমস হায়ার এডুকেশন ইভালুয়েশনে আমরা ২৪৫ নম্বরে উঠে এসেছি। এই তালিকায় ড্যাফোডিলও এসেছে। অন্যদের কারও নামই নেই। তার মানে কি-এই দুটিই তো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। এর আগে তো আমরা কখনো চেষ্টাই করিনি, এটাই আমাদের প্রথম পার্টিসিপেশন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে গিয়ে দেখেছি, খুবই করুণ অবস্থা। বিস্ময় জাগে, এত খারাপ স্ট্যান্ডার্ড পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের! অথচ তাদের গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ খুব হাই। তো এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিই।

একসময় আমার মনে হতো, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে বোধহয় খুব ভালো ফলাফল বেরুবে না। কিন্তু সিলেকশন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, তারা খুব ভালো করছেন। আমাদের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তো বেশ কিছু নিয়োগ দিয়ে ফেলেছি। আরও ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দিলে আরও ভালো হয় কারণ আমরাই তাকে চার-পাঁচ বছর পড়িয়েছি, আমার মনের মতো করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি, সুতরাং তাকে নিলে আমাদের আর কোনো সংকট হচ্ছে না।

কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে এখনো গড়পড়তা ধারণাটা চেঞ্জ হয়নি...
তা হয়নি। চার-পাঁচটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট বিক্রি করে। তো একজন পাপ করে, দোষ পড়ে সবার। আবার সার্টিফিকেটের ক্রেতাও আছে অনেক। গ্র্যাজুয়েশন করে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে ঢুকেছে, এখন আরেকটা ডিগ্রি হলে একটা প্রমোশন বাগিয়ে নেওয়া যায়। বিক্রি করার জন্য যেমন লোক আছে তেমনি ক্রেতাও আছে সেহেতু এটা চলছে। এই অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে।

অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল নিয়ে আপনার কী মন্তব্য?
আমি এর সমর্থক, এটার দরকার আছে। আমি একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে বলছি, আমি এর ঘোর সমর্থক। এই কারণে, এটা হলে ইউজিসির মাথাব্যথা কমে যাবে। ইউজিসির আসলে কোনো ক্ষমতা নেই। যার ক্ষমতা নেই, তাকে আর কর্তৃত্ব দিয়ে লাভ কি? অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলকে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব-দুটিই প্রচুর পরিমাণে দেওয়া হয়েছে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সীমিত আকারে হলেও ছাত্ররাজনীতির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে?
সেটা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ওরাই তো করতে চাইবে না। কারণ পড়াশুনার চাপ এত বেশি থাকে, এরা আসলে অন্যকিছুর মধ্যে মনোযোগই দিতে পারছে না। তবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আছে, খেলাধুলা আছে।

কিন্তু রাজনৈতিক স্লোগান কিংবা এসব কিছু করে না। তলে তলে হয়তো সংগঠন থাকতে পারে কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো ছাত্র সংগঠন বা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। তবে আমি সেদিন একটা জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম, দেখলাম তারা নানা সামাজিক কাজকর্ম করে এবং সবাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। খুব ভালো লাগল আমার। সমাজের দুস্থ মানুষ, নেতিয়ে পড়া মানুষদের টেনে ওঠাবার চেষ্টা করে। এটাই তো বড় রাজনীতি। ছাত্র সংসদ মনে করে, তারা পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়ে পলিটিশিয়ান হবেন। কিন্তু আমি মনে করি, ছাত্র সংসদ তো হচ্ছে নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য। সেটা পলিটিক্যাল নেতৃত্বও হতে পারে, আবার অন্য যে কোনো ধরনেরও হতে পারে।

সেসবের জন্য কি যথাযথ এনভায়রনমেন্ট আছে?
অবশ্যই আছে। শুধু একটা জিনিসই আমাদের এখানে হচ্ছে না, সেটা হলো ভোটাভুটির মাধ্যমে ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ তৈরি। যে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হবে-সে ক্লাস রিপ্রেজেন্টার হবে। এই নেতৃত্ব নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। পরের সেমিস্টারে যখন তার পজিশন চেঞ্জ হলে আরেকজন তার জায়গায় চলে আসবে তখন সে পাবে নেতৃত্ব। এভাবে নেতা তৈরি করার জন্য আমরা অন্য একটি প্রসেস ডেভেলপ করেছি। তুমি ক্লাস রিপ্রেজেন্টার হবা, মেন্টর হবা, ক্লাবের সদস্য হবা-তুমি কী রেজাল্ট করেছ? যদি ফার্স্ট হও, তুমি ক্লাস রিপ্রেজেন্টার।

আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বা উদ্যোক্তাদের অন্যতম। তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু নিয়ে সিলেবাসে কতটুকু আছে?
‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটা আলাদা বিষয়ই আছে। আমি তো মাঝে মাঝে গিয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজটা পড়াই। সারা সেমিস্টার অন্য শিক্ষকরা পড়ান। কিন্তু প্রথম দু’একদিন আমি নিজেই পড়াই। আমি আগাগোড়া নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। কারণ আমি ১৯৪৯ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তো সেভাবে আমি নিজের কথাবার্তাও বলি। রাজনীতির কথাবর্তা বলি, সমাজ, অর্থনীতির কথাবার্তাও চলে আসে। কারণ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণই হচ্ছে অর্থনীতি।

রাজনীতিও সেখানে রয়েছে, কারণ পুরো সময়জুড়ে আমরা একবার মাত্র প্রাইম মিনিস্টার পেয়েছি সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে। আরেকবার খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন গভর্নর জেনারেল। সোহরাওয়ার্দী আসলে বাঙালি ছিলেন না, খাজা নাজিমুদ্দিন তো নয়-ই। তো আমরা বাঙালিরা সেভাবে কোনোদিন শাসনও করতে পারিনি। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারিনি, চাকরি-বাকরিও ছিল না। আর তা ছাড়া বাঙালিরা খুব অবমাননার শিকার হয়েছিল। আইয়ুব খান যেদিন বলেছে, বাঙালি হলো হিন্দুর জারজ, সেদিন আমাদের গায়ে আগুন লেগে গেছে। তারপর থেকে আমরা শপথ নিয়েছি, এই হারামজাদাদের সঙ্গে কোনোদিন থাকা যাবে না।

আপনি দেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু সঙ্গে এও কি সত্য নয়, আমরা রাজনীতি, সমাজ-এসবকে নষ্টও করে ফেলেছি?
আমাদের রি-থিংকিংয়ের প্রয়োজন হয়ে গেছে। আমরা তো অনেকখানি এগুলাম। এবার উন্নতিটাকে টেকসই করার জন্য কী কী করতে হবে-তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমি কায়মনবাক্যে প্রার্থনা করি, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকুক। তারা যখন আবার ক্ষমতায় আসল, আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি বলব, স্বপক্ষের এই শক্তিটা তাদের নিজেদের সংস্কার করতে হবে, পরিমার্জন করতে হবে। জনগণের অতি কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে।

এখন সাধারণ মানুষের প্রতি গভীরভাবে নজর দেওয়া উচিত। জানি সাধারণ মানুষের প্রতি নজর দিতে গেলে বিপদ হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যা হয়েছে, সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। খেটে-খাওয়া মানুষের প্রতি নজর দিতে হবে। গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে নতুন করে তৈরি করতে হবে।

জীবনের অনেক বছর পেরুলো। তৃপ্তি-অতৃপ্তি নিয়ে কিছু বলবেন?
মনের মধ্যে কষ্ট আছে। যুদ্ধ করে যে দেশটা তৈরি করলাম, সেই দেশটাকে আমার আরও কিছু কন্ট্রিবিউট করার ছিল। সেটা হয়তো যথাযথ পারিনি। আবার কন্ট্রিবিউট করতে গেলে একটা অবস্থানের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে আমার যতটুকু সম্ভব দেশের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছি। দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। ইউনিভার্সিটিতে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েদের, সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায়, কম পয়সায় পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। এটুকু তো করলাম। করার আরও জায়গা হয়তো ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সার্ভ করতে পারতাম। তাদের পরিবারকে সার্ভ করতে পারতাম। সেটা হয়তো যথাযথ পারিনি। এটা হতে পারে আমার ব্যর্থতা।

তা ছাড়া আরেকটা কষ্ট আমাকে খুব তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখের সামনে যাদের বঙ্গবন্ধুর চামড়া তুলে ফেলার স্লোগান দিতে দেখলাম তারা এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে সবকিছু নির্ধারণ করেন। আর আমি সেই পথের ভেতরে এখনো ঘুরে বেড়াই। কেউ কেউ আমাকে চেনেন, সম্মান করেন আবার যারা চেনেন না, তারা মনে করেন, রাস্তার লোক। এটা আমার জন্য অবর্ণনীয় কষ্টের বিষয়।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
খোলা কাগজ পরিবারের জন্য শুভকামনা।

(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

 
Electronic Paper