ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইঁদুর নিধনে আবুলের বাঁশকল

কামরুজ্জান তোতা, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
🕐 ৯:৪৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১

ইঁদুর নিধনে আবুলের বাঁশকল

কৃষকবান্ধব বয়োবৃদ্ধ আবুল হোসেন জোয়ার্দার ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের জামাল ইউনিয়নের উল্ল্যা গ্রামের বাসিন্দা, বয়স ৮২, পেশায় পল্লী পশু চিকিৎসক। সঙ্গে সঙ্গে বিগত ৪৫ বছর মানুষের ফসলের শত্রু ইঁদুর নিধন করে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লক্ষাধিক ইঁদুর নিধন করেছেন। এ কাজে ব্যবহার করেন নিজের তৈরি বাঁশকল বা ফাঁদ। মৃত ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে সরকারি ইঁদুর নিধন দিবসে উপজেলা থেকে কয়েকবার সম্মাননাও পেয়েছেন।

সরেজমিন আবুল হোসেনের বাড়িতে দেখা যায়, তার বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা রয়েছে প্রায় শতাধিক বাঁশকল বা ফাঁদ। টিনের তৈরি একটি চালা ঘরে বেশ কিছু টিনের কৌটার মধ্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে মরা ইঁদুরের অসংখ্য শুকনো লেজ। যা তিনি উপজেলাতে জমা দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

আবুল হোসেন জোয়ার্দার জানান, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের বাবুনগর মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে তিনি পল্লী পশু চিকিৎসক হিসেবে বিশেষ কোর্স শেষ করেন। এরপর বিস্তর এলাকায় শুরু করেন পশু চিকিৎসাসেবা। এ কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে শুরু করেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল নিধনের শত্রু ইঁদুর নিধন। তিনি বলেন, কৃষকরা অনেক কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন। সেই ফসল ইঁদুরে বিনষ্ট করে। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের একটি ক্ষতি। তাই কৃষকদের উপকারে তিনি শুরু করেন ইঁদুর নিধন। যা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রথমে বাজারের কেনা কল বা ফাঁদ ব্যবহার করতেন। এ ফাঁদে তেমন একটা কাজ করে না।

তাছাড়াও ব্যয়বহুল হওয়ায় পরে মাথা খাটিয়ে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ফাঁদ বাঁশকল। তার এ চেষ্টা আজ সফল হয়েছে। এলাকায় এটা আবুলের বাঁশকল হিসেবে পরিচিত। ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষের সময় এ ফাঁদগুলো নিজের উদ্যোগে মাঠের বিভিন্ন খেতে নিজ উদ্যোগে পুঁতে রাখেন। কয়েক দিন পরে দেখেন অনেক ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়েছে। অনেকগুলো মারাও গেছে। বিভিন্ন গ্রামের মাঠে তার কয়েক হাজার বাঁশকল পাতা আছে, বছরের ইঁদুর নিধন সপ্তাহে ইউএনও অফিসের মাধ্যমে কৃষি অফিসে জমা দেন অসংখ্য শুকনো লেজ। লেজ জমা দিয়ে এ পর্যন্ত তিনিই প্রতিবছর সেরা হন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এসে ফাঁদ নিয়ে যায়। তিনি বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হুমায়ন কবির জানান, কৃষকদের ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া কমপক্ষে ৬০ রোগের জীবাণু বহন করে। এই ইঁদুর নিধনে আবুল হোসেন নিজের তৈরি বাঁশকল দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর তিনি প্রচুর পরিমাণে ইঁদুরের লেজ জমা দেন। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক তথ্যে জেনেছেন ইঁদুর খুব দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটায়। ইঁদুরের গর্ভধারণকাল ১৮-২২ দিন পর্যন্ত হয়। বাচ্চা প্রসবের পরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করতে পারে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে নিধন করা কতটা জরুরি। যে কাজটি আবুল হোসেন বিনা পারিশ্রমিকে করে থাকেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মুহাম্মদ মোহায়মেন আক্তার জানান, ইঁদুর পাকা ধান, গম, রবিশস্য, সবজি, বাসা বাড়ির কাগজপত্র ও কাপড় চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে। কৃষি জরিপে দেখা গেছে, ইঁদুর বেশিরভাগ সেচনালা গর্ত করে পানির অপচয় ঘটায়। ফসল কাটার পূর্বে ধানখেত ৫ থেকে ১৭ ভাগ পর্যন্ত নষ্ট করে। তিনি বলেন, ১০০ টি ইঁদুর বছরে ১ টন খাদ্য খেয়ে ফেলতে পারে। এ ইঁদুর নিধনের জন্য উপকারী প্রাণী পেঁচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুঁই সাপ, বিড়াল জাতীয় প্রাণী কমে যাওয়ায় মাঠে ও বাসা বাড়িতে ইঁদুর বেড়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। কিন্তু স্বেচ্ছায় আবুল হোসেন তার উদ্ভাবিত বাঁশকল কৃষকদের সেবা প্রদান করছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূবর্ণা রানী সাহা জানান, ফসলি খেতের জন্য ইঁদুর একটি ভয়ানক শত্রু। প্রতিবছর সরকারিভাবে ইঁদুর নিধন সপ্তাহ দিয়ে ইঁদুর নিধনে কাজ করা হয়। কৃষকদেরকে ইঁদুর নিধনে উৎসাহিত করতে মরা ইঁদুরের লেজ জমা নিয়ে জমাদানকারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ উপজেলায় আবুল হোসেন জোয়ার্দার প্রতিবছরই সকলের চেয়ে বেশি জমা দিয়ে আসছেন। তার নিজের প্রযুক্তিতে তৈরি বাঁশকল এলাকার সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বিনা পারিশ্রমিকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে সেবাটা দিচ্ছেন বলা যায় আবুল হোসেনই কৃষকদের প্রকৃত বন্ধু। তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

 

 
Electronic Paper