ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ওষুধ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের কাণ্ড!

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৩:১৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০২০

খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের ওষুধ কেলেঙ্কারির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলার আসামি ডা. অলোক কুমার মন্ডল (বহিস্কৃত) এবার নারী নির্যাতন মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। ওই মামলায় তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত। গত ২৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার স্ত্রীর করা মামলায় খুলনা থেকে গ্রেফতার করা হয় ডা. অলোককে। এরপরই উঠে আসতে শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. অলোক কুমার মন্ডল দুই বছর আগে তার নিজের ক্লিনিক স্টার ডায়াগনস্টিকের রিসিপশনিস্টের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকে তিনি স্ত্রী-কন্যা থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন। তার স্ত্রী ডা. লিপিকা সরকার ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি কয়েকমাস আগে তার স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। এ নিয়ে তাদের সংসারে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ চলে আসছিল। এক পর্যায়ে স্ত্রীকে মারধরও করেন ডা. অলোক। এদিকে স্বামীকে অবৈধ সম্পর্ক থেকে ফেরাতে ডা. লিপিকা ঢাকা থেকে খুলনায় গিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। এতে তার প্রতি নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পরে পারিবারিকভাবে বিষয়টি মেটাতে গিয়ে গত ৪ অক্টোবর ডা. অলোকের প্রেমিকাকে ২০ লাখ টাকাও দেওয়া হয়, সেই সঙ্গে স্ট্যাম্পে এ সংক্রান্ত চুক্তিও করা হয় যে ওই নারী টাকা নেয়ার পর আর অলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। এরপরও ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল ডা. অলোকের।

অবৈধ সম্পর্কের নেপথ্যে ক্লিনিক বাণিজ্য:
এদিকে ডা. অলোকের স্ত্রী ও তার পরিবার দাবী করেছে, স্টার ডায়াগনস্টিকের রমরমা ব্যবসা বহাল রাখতে আর ডা. অলোক যাতে অন্য কোথাও রোগী না দেখতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে তাকে ওই নারীর সংস্পর্শে আনা হয়েছে। শুক্রবার দৈনিক খোলাকাগজের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয় লিপিকা সরকারের ভাই ডা. মনোজ কুমার সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, খুলনায় লিটন হালদার নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি খুলনা ডিসি অফিসে কর্মরত। পাশাপাশি তিনি ওই এলাকায় জমির দালালি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। পরবর্তীতে লিটন স্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে ক্লিনিক ব্যবসা শুরু করেন।

ডা. মনোজ জানান, ডা. অলোক যখন খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের সরকারি ওষুধ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ফেঁসে যায়, তখন লিটনরা তার সহায়তায় এগিয়ে আসে এবং সেখান থেকেই তাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজের ক্লিনিক জমাতে ডা. অলোককে সেখানে যুক্ত করেন লিটন। তবে স্টার ডায়াগনস্টিকে রোগী দেখার পাশাপাশি খুলনার আরও তিন-চারটা ক্লিনিকে বসতেন অলোক।

তিনি বলেন, আমার ভগ্নিপতি কখনো এমন ছিল না। আমরা পরবর্তীতে জানতে পেরেছি স্টার ডায়াগনস্টিকের রমরমা ব্যবসা বহাল রাখতে ডা. অলোক যাতে অন্য কোথাও রোগী না দেখতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে তাকে ওই নারীর সংস্পর্শে আনা হয়েছে। আর এটা করেছেন লিটন নামের ওই ব্যক্তিই। ওই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা, ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, রোগীদের অতিরিক্ত টেস্ট করিয়ে বিলের পাহাড় জমানোসহ নানা অনিয়ম হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ওই নারীকে ডা. অলোকের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য টাকা দেয়ার প্রস্তাবটা প্রথম উত্থাপন করেছিলেন এই লিটন ও তার সহযোগী ওই ক্লিনিকের মার্কেটিং অফিসার জাহিদুল ইসলাম। তারা এসে আমার বোনকে বলে, এই মেয়ে অলোকের জীবন থেকে সরে যাওয়ার বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা চেয়েছে। কিন্তু আমরা ২০ লাখ টাকায় বিষয়টি দফারফা করতে পারবো। তখন আমার বোন আত্মীয় স্বজনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লোন নিয়ে ২০ লাখ টাকা ব্যবস্থা করে এবং স্ট্যাম্পে চুক্তির বিনিময়ে সে টাকা হস্তান্তর করে। কিন্তু টাকা দেয়ার পরও ওই নারী ডা. অলোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তখন লিটন আমাদের জানায় এই ২০ লাখ টাকায় ওই নারী মানছে না, তাকে আরও ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। তখন আমার বোন ২০ লাখ টাকার একটি চেক তাদের সরবরাহ করে। তবে সেই টাকা ওই নারীর কাছে না যাওয়ায় আমাদের সন্দেহ হয় আসলে লিটনরাও এই অপকর্মের সাথে সরাসরি যুক্ত।

এতকিছুর পরও প্রতিনিয়ত স্বামীর অত্যাচারের শিকার হচ্ছিলেন ডা. লিপিকা সরকার। এক পর্যায়ে স্বামীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে খুলনা সদর থানায় তিনি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে ৩ নভেম্বর বোনের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ ঢাকার রমনা থানায় আরেকটি জিডি করেন তার ভাই মনোজ সরকার। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল না পাওয়ায় ঢাকায় ফিরে গত ১৩ নভেম্বর রমনা মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন তিনি। মামলা হওয়ার পর অলোক পলাতক ছিলেন। অবশেষে তাকে খুলনা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি এই দুই চিকিৎসকের বিয়ে হয়। তাদের ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। মামলায় বাদী অভিযোগ করেন, অবৈধ সম্পর্ক ছাড়াও তার সব সম্পত্তি লিখে দিতে তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন স্বামী অলোক।

রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ডা. অলোকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে তার স্ত্রী লিপিকা সরকার মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে যৌতুক, নির্যাতন ও অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামি গ্রেফতার হয়েছেন, আদালতের নির্দেশনায় বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছে। তিনি দোষী হলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ডা. অলোক কুমার মন্ডল খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে আরএমও পদে যোগদান করেন। ২০১৭ সালে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ বিক্রির অভিযোগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডা. অলোককে গ্রেফতার করে পুলিশ। সঙ্গে তার সিন্ডিকেটের আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় ওষুধ বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক।

ওষুধ কেলেঙ্কারির মামলায় দুই মাস খুলনা জেলে বন্দি থাকেন তিনি। সেখান থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও হাসপাতাল থেকে এখন তাকে সাসপেন্ডে রাখা হয়। পরে তিনি খুলনার স্টার ডায়াগনস্টিকসহ তিন ডায়াগনস্টিকের শেয়ার নেন। খুলনা জেলার দাকোপ থানার চালনা বাজারের মৃত লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল এবং মৃত অসীমা মন্ডলের ছেলে ডা. অলোকের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি ও নিয়মিত মদ্যপানের অভিযোগ রয়েছে।

 
Electronic Paper