প্রতিশ্রুতি-পরিদর্শনেই কেটে গেল ১১ বছর
মো. জামাল হোসেন, খুলনা
🕐 ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০
প্রতিশ্রুতি-পরিদর্শন আর পরিকল্পার মধ্যে ১১ বছর আটকে আছে খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জনপদ কয়রায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। সর্বশেষ তিন মাস আগে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৮০ কিলোমিটার নির্মাণ সম্ভব হয়নি। এ কারণে উপজেলার মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন।
এলাকাবাসী জানান, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডরের জলোচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় কয়রা উপজেলা। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর ২০১৯ সালের ১০ মে ফণি ও ১০ নভেম্বরের বুলবুলে বাঁধ ভেঙে বেশ ক্ষতি হয়। এরপর চলতি বছরের গত ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফানে ৪ ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডবে বাঁধ, ঘরবাড়ি সব তছনছ হয়ে যায়। উপজেলার ২১টি স্থানে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে প্রথম দিকে ৯টি স্থান ভেঙে লোকালয়ে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি প্রবেশ করে। পরে আরও ৫টি স্থান ভেঙে যায়। এতে ৪২টি গ্রাম লবণ পানিতে প্লাবিত হয়। ৫১ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ১ লাখ ৮২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আজও সেই লোনা পানি থেকে মুক্তি মেলেনি কয়রার অধিকাংশ মানুষের।
এমন পরিস্থিতিতে ২০ আগস্ট থেকে জোয়ারের পানিতে আবারও বাঁধ ভেঙে কয়রায় চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ। কপোতাক্ষ আর কয়রা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে ২ নম্বর কয়রা, গোবরা, ৩ নম্বর কয়রা ও বেদকাশি গ্রাম। এর আগে ১৯ আগস্ট বাঁধ ভেঙে উপজেলার কাজীপাড়া, পুটিহারী, হরিণখোলা, কাশিরহাট খোলা ও ঘাটাখালি গ্রাম প্লাবিত হয়। লোনা পানিতে ওইসব গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এমন দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যেও দুর্গতদের লড়াই থেমে থাকেনি। এলাকার তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ সবারই প্রচেষ্টা ছিল ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের। গত তিন মাস ধরে তারা কাজ করে চলছেন।
পাউবোর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, উপকূলীয় এলাকার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৮ হাজার কোটি টাকার ৪টি প্রকল্প গ্রহণ করার কথা জানানো হয়। এরপর চলতি অর্থবছর থেকে এ কাজ শুরুর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। ৪টি প্রকল্পের মধ্যে দুটি খুলনা এবং অপর দুটি সাতক্ষীরায়। পাউবোর সাতক্ষীরা জোনের ৫ ও ১৫ নম্বর পোল্ডার প্রকল্পভুক্ত হলেও অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত ১৪/১, ১৪/২ পোল্ডার দুটি টেকসই বেড়িবাঁধ প্রকল্পভুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। অথচ এ দুটি পোল্ডার মারাত্মক নদী ভাঙনকবলিত উপকূলীয় জনপদ হিসেবে পরিচিত। ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও ২০২০ সালে আম্ফানের জলোচ্ছ্বাসে ১৪/১, ১৪/২ পোল্ডার বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
গোবরা গ্রামের মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা জোয়ারে ডুবি আর ভাটায় ভাসি। ঝড়-বৃষ্টি হলেই বছরের অধিকাংশ সময় এ অবস্থা হয়। এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবে আর কতকাল চলব আল্লাহ জানেন।’
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আইলা থেকে আম্পান ১১ বছর। এখনো পর্যন্ত প্রাপ্তির খাতা কিন্তু শূন্য। বড় কাজে দেরি হয়, জনগণও সেটা বোঝে কিন্তু আপাতত ভাঙনের স্থানগুলো বেঁধে যে পানি মুক্ত করা ব্যবস্থা সেটাও করা হয়নি। এ অবহেলা মেনে নেওয়ার মতো না। স্বেচ্ছাশ্রমে কয়রার মানুষ যে রিং বাঁধগুলো দিয়েছে তার উপর এক ঝুড়ি মাটি ফেলতে পারেনি পাউবো। অনেক স্থান এখনো ভাঙা। জোয়ারের পানি সেখান দিয়ে হু হু করে ঢুকছে। কয়রার মানুষের যে কি দুর্বিষহ কষ্ট তা বলে শেষ করা যাবে না।’
দক্ষিণ বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান জি এম কবি শামছুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার ইউনিয়নে পাউবোর ২৭ কিলোমিটারসহ উপজেলার সিংহভাগ বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ এ সব বাঁধ কয়েকবার পরিদর্শন করে গেছেন। জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে অনেকবার সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ পাউবো টেকসই বাঁধ নির্মিত হবে তার কোনো হদিস নেই।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, এটা ভাঙনকবলিত এলাকা। টেকসই বেড়িবাঁধ আজও হয়নি। নব্বই দশকের পর থেকে শুধু রিং বাঁধ হয়েছে। জনগণ বেঁচে থাকার তাগিদে নিজ উদ্যোগে কয়রার বাঁধ নির্মাণ করে। কিন্তু সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পাউবো।
এ বিষয়ে পাউবোর ১৪/১ পোল্ডারের শাখা কর্মকর্তা মো. মশিউল আবেদীন বলেন, সরকার সুন্দরবন উপকূলীয় কয়রায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে সেটা বলতে পারব না।
পাউবো সাতক্ষীরা নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু সরকার বলেন, কয়রার ১৪/১ ও ১৪/২ পোল্ডারের দুটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসে ১৪/১ পোল্ডারের প্রকল্পটি প্ল্যানিং কমিশনে চলে গেছে। এখন একনেকে পাস হলে কাজ শুরুর বিষয়ে বলা যাবে।