লালনধামে ভক্তের মিলন মেলা
দেবাশীষ দত্ত, কুষ্টিয়া
🕐 ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৯
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১২৯তম তিরোধান দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে। সব পথ যেন এসে মিশেছে মরা কালীর নদীর তীরে আখড়াবাড়িতে। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা ছেঁউড়িয়া। কিন্তু এখন সে রাস্তায় যেতে সময় লাগছে ১ ঘণ্টারও বেশি। গভীর ভালোবাসায় ভক্ত-অনুরাগীরা ছুটে এসেছেন দলে দলে। মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, আবার কেউ গেরুয়া বসনে।
সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। ‘বাড়ির পাশে আরশীনগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’- এ রকম অসংখ্য লালনসঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় তারা মাতিয়ে তুলেছেন বাউলধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন গানে গানে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও।
গতকাল বুধবার বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু কর্তৃপক্ষের দেওয়া সকালের অধিবাসে পায়েস ও মুড়ির বাল্যসেবা গ্রহণ করেন। আজ বৃহস্পতিবার তারা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে মাছ-ভাত ও ত্রিব্যঞ্জন দিয়ে (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করবেন।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, আর প্রেমজুড়ির তালে মাতোয়ারা হয়ে উঠছেন বাউলরা। ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথি তথা দোল পূর্ণিমায় শত বছর ধরে এভাবেই বাউল সাধকরা জড়ো হন বাউলতীর্থে।
মূল গেট থেকে ভেতরে ঢুকে অডিটোরিয়ামের নিচে বসে আছে প্রবীণ বাউল নহির শাহ। বয়স প্রায় ৭৯ বছর। শিষ্যদের নিয়ে গানে মজেছিলেন। এখনো আঁটা স্বাস্থ্য। দেখে বোঝা যায় না বয়স। গান থামালে কথা হয় এ বাউলের সঙ্গে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, এই দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথায় যায় না জানিসহ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন তিনি। গানের মর্মকথা জানতে চাইলে এ বাউল বলেন, বুঝে নিতে হবে!
তিরোধান দিবসে প্রতি বছরের মতো এবারও সাধক লালনের আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রাণের টানে ছুটে আসেন। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। একই সঙ্গে চলছে দীক্ষাপর্ব। নব্য শিষ্যরা গুরুদের সেবা করতে উদগ্রীব। যেন কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে তাদের অটুট লক্ষ্য। লালন ধামের ভেতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল কামিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভেতর আধ্যাত্মবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। নাচতেন।
বাউল ফকির পূর্ণেন্দু দাস জানান, এ পথে আসার এক বছর পার হয়েছে। এখনো কিছুই শিখতে পারিনি। গুরুর সঙ্গেই থাকি দিনরাত। তার খেদমত করাই আমার কাজ। গুরু বলেছেন সময় হলে গুরুবাক্য দেওয়া হবে।
বাউলসাধক ফকির লালন সাঁইয়ের জীবন-কর্ম, জাতহীন মানবদর্শন, মরমি সঙ্গীত ও চিন্তা-চেতনা এখন আর এই ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশে^। তার সঙ্গীত ও ধর্ম-দর্শন গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
উৎসবে শামিল হতে খুলনা থেকে ছুটে এসেছেন এক নবদম্পতি। সৌদি প্রবাসী স্বামী আব্দুল গাফফার বলেন, লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তার স্ত্রী নারগিস পারভিন বলেন, লালন সাঁইজির আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত। তিনি লালনের গান কবিতা আকারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানান।
লালন সাঁইজি জীবিত থাকাকালে ফাল্গুন মাসের শেষে দোল পূর্ণিমা তিথিতে কালী নদীর তীরে শিষ্যদের নিয়ে রাতভর গান-বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা করতেন, যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে লালন স্মরণোৎসবে।
দূর-দূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে নৃত্যসঙ্গীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদোম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা। হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভেতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ। স্মরণোৎসব চলবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত।