কুষ্টিয়ায় রেলসেতুতে লোহার বদলে বাঁশ!
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
🕐 ৮:৪৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৯, ২০১৯
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় কালভার্ট ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনার হতাহতের পর কুষ্টিয়ার রেলসেতুগুলোর পরিস্থিতি দেখে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। লোহার পেরেকের পরিবর্তে কুষ্টিয়ার বেশ কয়েকটি রেলসেতুতে দেখা যায় বাঁশের ব্যবহার। সাইকেল ও মোটরসাইকেলের অব্যবহৃত টায়ারের অংশ দিয়েও জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে।
শতবর্ষের পুরনো এসব রেলসেতুতে মাঝেমাঝে কাঠের স্লিপার পরিবর্তন করা হয়। এসব স্লিপার যাতে উঠে না যায় এজন্য পেরেক দিয়ে বাঁশ ও টায়ারের অংশ গেঁথে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সেতুর ওপর বেশ কিছু লোটার বোল্ট না থাকায় বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের গোঁজ। এই সব জায়গায় যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ সরকার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে এবং এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার হয়। কুষ্টিয়ার পোড়াদহ থেকে রেলযোগে রাজশাহী-ঢাকা-রাজবাড়ী-খুলনা রুটে ট্রেনে এসব জায়গায় যাওয়া যায়। ১৮৯৭ সালে দর্শনা-পোড়াদহ সেকশনটি সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোড়াদহ-ভেড়ামারা এবং ১৯১৫ সালে ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী সেকশনগুলোকেও ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ-হালসা রেলওয়ে ষ্টেশনের মধ্যবর্তী কাটদহচর এলাকায় দেখা যায় ছোট একটি রেলসেতু। এর নম্বর ১৯১। এ সেতুটি তৈরি হয়েছে ১৮৯৭ সালে। আপ এবং ডাউন মিলিয়ে প্রতিদিন সেতুটির ওপর দিকে প্রায় ২৫টি ট্রেন এবং মালবাহী গাড়ি চলাচল করে। দর্শনা-পোড়াদহ রুটের সব ট্রেন ও মালবাহী গাড়ি চলে এই সেতুর ওপর দিয়েই। তবে এই সেতুর কাঠের স্লিপারগুলো বেশ পুরাতন হয়ে গছে। সেগুলো যাতে ট্রেন চলাচল করার সময় পানিতে পড়ে না যায় এজন্য বাঁশের বাতা এবং বাঁশের গোজ দিয়ে আটকানো রয়েছে।
এর দুই কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে আরও দুটি রেলসতু। সেগুলোর অবস্থাও একই রকম। যেন বাঁশেরই উত্তম ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও সেতুর সঙ্গে দুপাশের রেললাইন আটকানো ক্লিপ বেশ কিছু স্থানে নেই। লোহা দিয়ে আটকানোর কথা থাকলেও মাঝে মাঝে বাঁশ দিয়ে যেন আরো বেশি শক্তিশালী করা হয়েছে, এমনটাই আক্ষেপ স্থানীয়দের।
১৯২ নম্বর সেতুটির অবস্থা কিছুটা ভালো। কয়েকদিন আগেই পরিবর্তন করা হয়েছে কিছু কিছু স্লিপার। তবে সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের তৈরি গোজ। স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস আলী জানান, সেতুটির কাঠগুলো অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। এই কাঠগুলো পরিবর্তন করা দরকার। আর অনেক স্থানে পিন না থাকায় ট্রেন গেলে রেললাইন সরে যায়। পিন কম থাকার কারণে কোনো রকম চলার জন্য লোহার পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে পিন তৈরি করে স্লিপার আটকে দিয়েছে।
এক কিলোমিটার উত্তরে কামারডাঙ্গা (১৯৪ নম্বর) রেলসেতুতেও রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। সেই সঙ্গে কিছু কিছু স্থানে নেই কোনো ক্লিপ। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হান্নান জানান, রেলগাড়ি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় যাতে স্লিপার উঠে বা সরে না যায় এজন্য বাঁশ দেওয়া হয়েছে। নাট না থাকায় বাঁশের গোজ ব্যবহার করেছে। তিনি আরও বলেন, যারা এর দায়িত্বে আছেন তারা নাট না দিয়ে বাঁশের গোজ দিয়েছে। বাপের জন্মে রেল সেতুতে বাঁশ দিয়েছে তা কোনো দিনও দেখিনি। এ ছাড়াও বেশ কিছু রেললাইনের ক্রসিং এ গেট ও গেটম্যান না থাকায় আতঙ্কে থাকে ছোট ছোট যানবাহনে চলাচলরত যাত্রী ও চালকরা।
পাখিভ্যানের যাত্রী শায়েদা খাতুন জানান, রেলের গেট না থাকায় বুকের ভেতর ভয় লাগে যদি গাড়ি চলে আসে। এই ভয় নিয়েই প্রতিনিয়ত রেললাইন পার হতে হয়।
এদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেলসেতু পার হওয়া ইয়ার আলী জানান, সেতুটির বেশি কিছু স্লিপার নড়বড়ে হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যেই পরিবর্তন করে। তবে কি যে করে তা বলতে পারব না। লোহার পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে গেছে।
হেঁটে আসা স্কুলছাত্র মিরাজুল ইসলাম জানান, আর কোনো রাস্তা না থাকায় আমি এই রেলব্রিজের ওপর দিয়েই স্কুলে যাই। যদি রেল চলে আসে তাহলে পাশের লাইনে ঝাঁপ দেবো।
পোড়াদহ রেলওয়ে জংশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার নাজমুল হাসান জানান, আমাদের এই অঞ্চলের রেলসেতুগুলো অনেক পুরনো হলেও এখনো অনেকটা ভালো। অদ্যাবধি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
পোড়াদহ রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার শরিফুল ইসলাম জানান, যাতে রেল চলার সময় জাম্পিংয়ে ক্লিপারগুলো সরে বা নড়ে না যায় এজন্য বাঁশের বাতা বাঁধা হয়েছে। নাটের পরিবর্তে বাঁশের গোজ তো স্থায়ী থাকবে না। এটা হলো অতিরিক্ত সতর্কতা।