মধ্যরাতের বৃষ্টিতে ডুবল নগরী
মো. জামাল হোসেন, খুলনা
🕐 ৮:৫৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২২
সম্প্রতি অনাবৃষ্টির কারণে খুলনা অঞ্চলের ফসলের মাঠ এবং খেত খামার ও মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছিল। পানির অভাবে সব শুকিয়ে চৌচির হওয়ার উপক্রম। কিন্তু এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ভারি বর্ষণে ডুবে যায় খুলনা শহরের অধিকাংশ এলাকার ভবনের নিচতলা।
প্লাবিত হয় নিম্ন অঞ্চল ও শহর অঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়ি। ডুবে যায় শহরের সমস্ত সড়ক। প্লাবিত হয় মৎস্য ঘেরসহ ফসলের ক্ষেত। ফলে কাজে আসছেনা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে করা বিভিন্ন সময়ের পয়নিষ্কাশন প্রকল্পগুলো। ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
এদিকে, রাতের বৃষ্টিতে খুলনা শহরের রাস্তাঘাটসহ অধিকাংশ বাড়ির নিচতলা ডুবে ঘরের ভিতরে পানি প্রবেশ এবং সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়ায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। জলাবদ্ধতায় বিপাকে পড়ে নগরীর পরীক্ষার্থীরা। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য শহরে রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল কম হওয়ায় যথাসময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে তাদের চরম বেগ পেতে হয়।
খুলনা আবহাওয়া অফিস বলছে, লঘু চাপের প্রভাবে মধ্যরাতের হঠাৎ ভারী বর্ষণ বিগত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খুলনা আবহাওয়া অফিস বুধবার ভোর ছয়টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
নগরবাসী বলছেন, খালগুলো দখল করে ভরাট করাসহ ধীরগতিতে ড্রেন নির্মাণ এ অবস্থার অন্যতম কারণ। অবিলম্বে এসব ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তাদের।
সূত্র জানায়, প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে খুলনা মহানগরের রূপসা, টুটপাড়া, নিরালা, মুজগুন্নী, বয়রা ও প্রান্তিকাসহ অধিকাংশ আবাসিকের বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। নীচ তলা নিমজ্জিত। সকল রাস্তায় পানি। পানি ঢুকেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। ফজর নামাজের সময় অধিকাংশ মুসল্লী রাস্তায় পানির কারনে মসজিদেও যেতে পারেননি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ড্রেন নির্মাণের কাজ করার জন্য মাটি ও বালুর বস্তা দিয়ে বেশির ভাগ ড্রেন আটকে দেয়ার কারণে অবস্থা আরো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে।
এছাড়া নগরীর পানি যাওয়ার অধিকাংশ খাল দখল করে বালি ভরাট করাও নগরী তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। অজ্ঞাত কারণে এসব চিহ্নিত ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাদের দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ফলে লাখ লাখ নগরবাসী আজ দুর্ভোগের মুখে।
কোনটি রাস্তা আর কোনটি জলাশয় চেনার উপায় নেই। অধিকাংশ রাস্তা পানির নিচে। ফলে চলতে পারছে না রিক্সা-ইজিবাইকও। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে এসএসসি ও সমমানের পরিক্ষার্থীরা। যথাসময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
নগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা মনিরা রত্না বলেন, ‘রাত সাড়ে ৩টার দিকে টের পেলাম ঘরে পানি ঢুকেছে। ১৯৮৭ সালে বাড়ি তৈরির পর প্রথমবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম।’
বড়খাল পাড় এলাকার বাসিন্দা মো. জাকির হোসেন বলেন, মধ্যরাতে ঘুমের মধ্যে তার ঘরের হাঁটু পানি জমা হয়। অনেক মালামাল ভিজে নষ্ট হয়। সারারাত ধরে শত চেষ্টা করেও পানি বন্ধ করা জায়নি। এমনকি সকালেও পানি ছিল।
এদিকে, বয়রা মডেল হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. নোমান বলেন, তার এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র বয়রার হাজী ফয়েজ উদ্দিন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সকালে হাঁটু পানি ভেঙে কেন্দ্রে ঢুকতে হয়েছে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলে যাওয়ার পথে রাস্তার কাদাপানি ছিটে কাপড় নোংরা হয়েছে।
নোমানের বড় ভাই নাসিব আহসান রুমি বলেন, ‘১১টায় পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়। কিন্তু রাস্তা, বাসা-বাড়ি পানিতে সয়লাব। এ কারণে ১০টায় ভাইকে নিয়ে নুরনগরের বাসা থেকে বের হই। জিপিও পার হয়েই নোংরা পানি। মোটরসাইকেল চালিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে দুজনেরই জামাকাপড় নোংরা হয়ে যায়। ’
তিনি বলেন, ‘স্কুলের সামনে গর্ত ছিল। পানির কারণে বুঝতে না পারায় গর্তে পড়ে দুটি ইজিবাইক উল্টে শিক্ষার্থীরা কাদাপানিতে ভিজে যায়। ওই অবস্থায়ই তাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। আমার ভাইও ভেজা প্যান্ট পরে খালি পায়ে পরীক্ষা দেয়। এভাবে ভেজা কাপড় গায়েই পরীক্ষা দিতে হয়েছে অনেককে।’
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সুপারিনটেনডেন্ট প্রকৌশলী মো. আব্দুল আজিজ বলেন, “বৃষ্টির পানিতে খুলনার অধিকাংশ রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।”
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ মোঃ আমিরুল আজাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে গত রোববার থেকে খুলনায় থেমে থেমে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত এ বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ১৩০ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিগত ছয় বছরের মধ্যে খুলনা অঞ্চলের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত।
তিনি বলেন, লঘুচাপ বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের মধ্যপ্রদেশে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু লঘু চাপের প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। যে কারণে আরও ২/১ দিন বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, বিগত পাঁচ/ছয় বছর আগে এই অঞ্চলে সর্বোচ্চ ১৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। তারপর থেকেই খুলনা অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়।