ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সা ক্ষা ৎ কা র

‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমকালীন হতে হবে’

প্রীতম সাহা সুদীপ ও আরিফুল ইসলাম
🕐 ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১

‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমকালীন হতে হবে’

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজের মৃত্যু, ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি, গাঁজার কেক ব্রাউনি, আইস উদ্ধারসহ চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত বেশকিছু মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের রমনা বিভাগ। ২০২০ সালের ২০ জুন এই বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এইচ এম আজিমুল হক। দায়িত্ব পাওয়ার পরপর তিনিই বিপুল পরিমাণ আইস উদ্ধার করেন। এছাড়া সম্প্রতি তার নেতৃত্বে এলএসডি, গাঁজার কেক ব্রাউনিসহ নতুন ভয়ঙ্কর কিছু মাদক উদ্ধার করা হয়।

এইচ এম আজিমুল হক ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে মনোনীত হয়ে বাগেরহাট সরকারি পি সি কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু স্বপ্ন ছিল পুলিশ হওয়ার। এজন্য অংশ নেন ২৫তম বিসিএসে। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট যোগ দেন পুলিশের এএসপি হিসেবে। ডিবি ডিসি রমনার দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি দীর্ঘদিন রমনা জোনের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আজ রোববার ডিসি আজিমের বর্তমান দায়িত্বকালের এক বছর পূর্ণ হলো। গত এক বছরে ডিবি রমনা বিভাগের সফলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক খোলা কাগজ। সাক্ষাৎকারে আজিমুল হক মত প্রকাশ করে বলেছেন, অপরাধকে নিম্নমুখি করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমকালীন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

ডিবি রমনার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোন দিকটিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?
দেখুন যতই দিন যাচ্ছে, অপরাধ ততই ডিজিটালাইজড হচ্ছে। আগে গাঁজা-মদ যেভাবে বিক্রি হতো, এখন পরিবর্তন হয়ে অনলাইনে বিক্রি হয়। এগুলোর সরবরাহ, তৈরি সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। আধুনিক হচ্ছে। তাই ক্রাইম ইন্টেলিজেন্সে আমাদেরও সমকালীন হতে হবে। অপরাধীরা এখন কী ভাবে? এদের মাথায় এখন কী আছে- এটা আমাদের জানতে হবে। আমি ডিবি রমনা বিভাগে আসার পর এদিকেই প্রথম নজর দিয়েছি। বিশ্বে সমকালীন যে অপরাধ চিন্তা, অপরাধের গতিবিধি, ধারা- এটা নিয়ে সমকালীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি।

অপরাধ নিম্নমুুখি করতে হলে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আসলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে তো বাংলাদেশে ক্রাইম ভাইব্রেন্ট আলাদা না। সেজন্য বৈশ্বিক অপরাধের যে ট্রেন্ড সেগুলোর সঙ্গে আমরা ইউজড টু হওয়ার চেষ্টা করছি। প্রতিটি অ্যাকশনেরই কিন্তু সমান রিঅ্যাকশন থাকে। এই রিঅ্যাকশন মিনিমাইজ করা যায়, তবে একেবারে নির্মূল করা যায় না। এখন তথ্য প্রযুক্তি বা ডিজিটালাইজেশনের যে কুফলগুলো আমাদের আছে, সেগুলো মিনিমাইজ করার কি কোনো উদ্যোগ আমাদের আছে? এখানেই হলো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ফেসবুকের যে কুফল বা রিঅ্যাকশনগুলো আছে, সেগুলো মিনিমাইজ করার কোনো উদ্যোগ কি আমাদের আছে? ইন্টারনেটের যে ক্ষতিকর দিকগুলো আছে, সেগুলো মিনিমাইজ করার জন্য কোনো পলিসি কি আমাদের আছে? এটা পলিসি লেবেলের কথা। সেই জায়গায় কাজ করতে হবে। মাদক এবং তথ্য-প্রযুক্তি সংক্রান্ত যেসব অপরাধ ঘটছে, এরপর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ সন্তানের ওপর অভিভাবকের প্রোপার গাইডেন্স বা নিয়ন্ত্রণ না থাকা। তাই শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না সব অপরাধ নির্মূল করা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি অভিভাবক ও প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে। সন্তানদের পারিবারিক মোটিভেশন দিতে হবে, যাতে তারা সেল্ফ মোটিভেটেড হয়ে স্বস্তার সুখ খুঁজতে গিয়ে বিপথগামী না হয়ে যায়।’

কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমকালীন হবে?
‘আমি চাই অপরাধ তত্ত্ব ও সমকালীন অপরাধের সঙ্গে সমকালীন হতে। সারা বিশ্বের অপরাধের যে ট্রেন্ড, ধারা, গতি, প্রকৃতি তার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমকালীন হবে। এখন যে ধরনের অপরাধ চলছে, সেটা যদি আমি পাঁচ বছর পর টের পাই তাহলে তো আমি পিছিয়ে থাকলাম। বরং অপরাধীদের থেকে আমাদের আপডেট থাকতে হবে। আপডেটেড হলেই কিন্তু আমরা অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ও বিচার বিভাগেরও একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। সমাজ ব্যবস্থারও একটা ভূমিকা আছে। যার যতটুকু ভূমিকা আছে, যার যতটুকু কাজ করার জায়গা আছে, সেই জায়গায় তাকে আপডেট থাকতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আপডেটেড না হতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধকে নিম্নমুখি করা যাবে না। মোট কথা এটা একটা সামষ্টিক এফোর্ট। অপরাধ একটা মানবিক আচরণ। জন্মের পর থেকেই প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা আচরণ হিসেবে থাকে অপরাধ প্রবণতা। তাই এই অপরাধ প্রবণতাকে কমিয়ে আনতে আমাদের সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, আইন, পরিবার সবাইকেই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্যসহ যত সুকুমারবৃত্তির চর্চা, এর মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে অধিকতর মানবিক করা। মানুষের মধ্যে যে অপরাধ প্রবণতাগুলো আছে সেগুলোকে নিম্নমুখি রাখা। এখন এই প্রত্যেকটা সূচক যখন আপডেট থাকবে, তখনই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’

এলএসডি, গাঁজার কেক ব্রাউনি, আইস- নতুন এই তিন প্রকার মাদক দেশে প্রথমবারের মতো ধরেছেন। আপনি দায়িত্ব পাওয়ার পর পরই ভয়ঙ্কর মাদক আইস ধরেন। দেশের জন্য আইস বেশ উদ্বেগের কারণ। এই মাদক সম্পর্কে কিছু বলুন।
আইসটা হচ্ছে ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান। এটা দেখতে ক্রিস্টালের মতন। এটা আসে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রথম যখন আমরা আইসের চালান ধরি, তখন সোর্স জানিয়েছিল- সোনা গলানোর জন্য বিদেশ থেকে এক ধরনের জিনিস আসে, সেটা মাদক হিসেবেও সেবন করা যায়। দেখতে সোহাগার মতো সাদা, ক্রিস্টাল টাইপ। তখন আমি স্টাডি করে জানতে পারি এটি আইস। এরপরই আমরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ আইস মাদক উদ্ধার করি। এই মাদকটা তখন উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা সেবন করত।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে এলএসডি উদ্ধারের ঘটনা খুব আলোচিত ছিল। কীভাবে এই ভয়ঙ্কর মাদকের সন্ধান পেয়েছিলেন?
‘সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাটা আমাকে অনেক বেশি নাড়া দেয়। আমরা ক্রিমিনোলজিতে পড়েছি একটা মানুষ আত্মহত্যা করলেও সে একটা সময় বাঁচতে চায়। তার মধ্যে বাঁচার একটা আকাক্সক্ষা জাগে। ধরুন একটা লোক গলায় ফাঁস দিয়ে সুইসাইড করল, সে যখন গলায় দড়িটা পরে তখন তার মধ্যে অনেক রাগ অভিমান কাজ করে। কিন্তু যখন সেই দড়িটাতে টান পড়ে তখন কিন্তু সে বাঁচার জন্য ছটফট করে। কিন্তু ঢাবি ছাত্র হাফিজ ডাব বিক্রেতার ভ্যান থেকে দা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গলা কাটছে, গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে তখনও সে বলছে যে- আমি বাঁচতে চাই না। আমি ট্রিটমেন্ট করতে যাব না। এই কথাটা একজন সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। একজন গোয়েন্দা হিসেবে আমার কাছে এটা স্বাভাবিক মনে হয়নি। মনে হয়েছে সাম থিং রং। একটা লোক যখন নিজের গলায় ছুরি দিয়েছে, ছুরি দিতেই পারে রাগে-কষ্টে-দুঃখে যে কোনো কারণে। কিন্তু গলা কাটার পর সে বাঁচতে চাইবে। কিন্তু এই ছাত্র যখন বাঁচতে চাচ্ছে না এখানে সাম থিং রং। আমরা তখন এটা নিয়ে তদন্ত শুরু করি। তদন্তের এক পর্যায়ে হাফিজের বন্ধু-বান্ধব, যাদের সঙ্গে সে মিশত ওরা বলল যে, সে নতুন একটা ড্রাগ নিত। সেই সূত্র ধরেই সামনে আসে এলএসডি। এরপর আমরা এলএসডি নিয়ে কাজ শুরু করলাম। পরবর্তীতে বাংলাদেশে যারা এটা বিক্রি করে, এদের দুই-তিনজনকে ধরে ফেললাম। আমি জানি না হাফিজ এই এলএসডি নেওয়ার পর মারা গেছে কিনা বা ওই ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছিল কিনা। এটা ওই মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে জানা যাবে। তবে আমার কাছে এটা ছিল অত্যন্ত অস্বাভাবিক। ঘটনাটা আরও বেশি অস্বাভাবিক মনে হয়েছে যখন ছেলেটা গলা কাটার পরও বলছে, আমি বাঁচতে চাই না, আমি ট্রিটমেন্ট করাব না। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে আত্মহত্যার মধ্যেও অন্য কিছু রয়েছে। কারণ একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনোই এটা বলতে পারে না।’

এলএসডি আসলে কোন ধরনের মাদক?
‘এলএসডিটা হচ্ছে ছোট্ট ডাকটিকিটের মতন দেখতে। আসলে এটি ডাকটিকিটের ছয় ভাগের এক ভাগ, ছোট্ট একটি কাগজের কণা। এলএসডির ফুল ফর্ম হচ্ছে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড। একটা ফাঙ্গাসকে প্রক্রিয়া করলে এই অ্যাসিডটা তৈরি হয়। যব, ভুট্টা বা যে কোনো দানা জাতীয় শস্যের মধ্যে এই ফাঙ্গাসটা মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়, সবসময় পাওয়া যায় না। এলএসডিকে লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ অর্থাৎ ড্রাগের শেষ পর্যায়ও বলা হয়ে থাকে।’

গাঁজার কেক উদ্ধারের ঘটনাও বেশ সাড়া ফেলেছিল, সে বিষয়ে একটু বলবেন?
‘এলএসডি বিক্রেতা যাদেরকে আমরা গ্রেফতার করেছি, তাদের মধ্যে একজন আমাকে তথ্য দিল যে, আগে তারা ব্রাউনিও বিক্রি করত। গাঁজার পাতা দিয়ে এক ধরনের কেক বানানো হয়, যেটাকে বলা হয় ব্রাউনি। নরমালি গাঁজা সেবন করলে এর প্রতিক্রিয়া একদিন পর্যন্ত থাকে। কিন্তু ব্রাউনিটা খুব স্ট্রং, এটার ঘোর সাত দিন পর্যন্তও থাকতে পারে। তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায়ও ব্রাউনি বিক্রি করা হয়। এরপর তো আমরা অভিযান চালিয়ে সাড়ে তিন কেজি ব্রাউনি উদ্ধার করলাম। আমাদের তালিকায় এমন আরও আছে, আমরা চেষ্টা করছি তাদের ধরার। আমরা মাদকের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি।’

 
Electronic Paper