ইব্রাহিম খালেদ দূরদর্শী ব্যাংকার ছিলেন
জাফর আহমদ
🕐 ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১
সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি ডেপুটি গভর্নর ছাড়াও তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও অপর এক রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কৃষি ও কৃষকের জন্য তিনি ছুটে চলেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার অভিজ্ঞতা, কর্মনিষ্ঠা, সততার জন্য বারবার ডাক পড়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর তল-উপর তদন্তে ডাক পড়ে তার। এই মহান ব্যাংকারের মৃত্যুতে আর্থিক খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাকে নিয়ে কী ভাবছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, পূবালী ব্যাংকে কর্মকালীন সহকর্মী ও ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী। কথা বলেছেন, খোলা কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাফর আহমদ।
তিনি আমার অভিভাবক ছিলেন
ড. আতিউর রহমান
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মৃত্যুবরণ করেছেন। তার কর্মবহুল ব্যাংকিং জীবনে অনেক ক্ষেত্রে আপনারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। আবার আপনাদের মিলও ছিল। তার অবর্তমানে আপনি তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সব চেয়ে বড় পরিচয় উনি মানুষের ও মানুষের অর্থনীতিবিদ। দায় ও জবাবদিহিতা জ¦লন্ত উদহারণ। সে জন্য তিনি আশা করতেন যে, আর্থিক খাতে যেন দুর্নীতি, স্বার্থন্বেষী মহল-এ গুলো যেনো সব সময় দূরে থাকে। সেজন্য তিনি মুখ খুলেছেন, কথা বলেছেন। নিজে যখন পূবালী ব্যাংকের এমডি হয়েছিলেন তখন ব্যাংকটিতে ৪০ শতাংশ খেলাপি ঋণ ছিল। সেই প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি এমনভাবে কাজ করেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নীচে নামিয়ে এনেছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন, সেটাই তিনি কাজ করে দেখিয়ে দিতেন। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি ছিলেন, বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর কোলে-পিঠে হওয়া মানুষ। তিনি সর্বদা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতেন। আর্থিক খাতে সব চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করতেন, সব সময় বলতেন সুশাসনের বিষয়টি নিয়ে। তিনি প্রত্যাশা করতে আর্থিক খাতে সব সময়ে যেন সুশাসন থাকে। সেজন্য একটি জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের পক্ষে ছিলেন।
তিনি যখন ডেপুটি গভর্নর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে ছিলেন পরিদর্শন বিভাগে অনেক রিফর্মের কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে যখন সোনালী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছিলেন তখনো উনি নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হননি। বিশেষ করে যে সব চাপ থাকত তা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। আমার মনে আছে আমি তখন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক। একদিন সকাল বেলায় তিনি আমার বাসায় চলে এসেছেন। বলছেন আমি আমার অফিসে যেতে পারছি না, গেলে নাকি আমাকে নাকি অপমান করা হবে। তারপর আমি পুলিশ ডেকে এনে পুলিশের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। পুলিশ যাবে এবং সারা দিন পুলিশ আপনার সঙ্গে থাকবে। তবুও কোনো আপস করেননি তিনি। অন্যান্য জায়গায় দেখেছি তিনি আদর্শবান একজন নেতা ছিলেন।
পূবালী ব্যাংকে দেখেছি তিনি কর্মীর ব্যাপারে খুব মনোযোগী ছিলেন!
আরও একটি গুণ ছিল তিনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন। আর প্রতিষ্ঠানের জন্য দরকার জনশক্তি সে জন্য তিনি জনশক্তির গড়ে তুলতে গুরুত্ব দিতেন। তিনি যখন পূবালী ব্যাংকে ছিলেন পূবালী ব্যাংক একটি প্রাইভেট ব্যাংক হলেও প্রথমেই তিনি ইয়াং ছেলেমেয়েদের নিয়োগ দিলেন এবং তা প্রফেশনাল ভঙ্গিতে। আমিও সেই পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলাম। তিনি শুধু নিয়োগই দিলেন না, প্রশিক্ষণও দিলেন। সেখানেই আমরা অংশগ্রহণ করলাম। এখানে তিনি কালচার অব এক্সিলেন্ট গড়ে তুলেছিলেন। প্রাইভেট ব্যাংক হওয়ার পরও তিনি এ কাজটি নিপুণভাবে করেছিলেন। তার নেতৃত্বের কারণে এখন পূবালী ব্যাংক একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে।
তিনি কৃষিঋণের ব্যাপারেও অত্যান্ত সচেতন ছিলেন। তিনি কৃষি ব্যাংকের এমডি হিসাবে তিনি গ্রামে-গঞ্জে যাওয়া শুরু করেছিলেন। কোন ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে গ্রামে যেতেন না। কিন্তু কৃষি ব্যাংকের এমডি হিসাবে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গ্রামে যাওয়া শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে আমি যখন গ্রামে যায়, তখন দুজন একসঙ্গে যেতাম। গ্রামে গেলে আমরা দুজন কৃষকের সঙ্গে কাজ করতাম। যখন তিনি কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন দায়িত্ব পালন করলেন, তখনো তিনি গ্রামে ছুটে গেছেন। যখন কৃষি ব্যাংক থেকে দায়িত্ব পালন অবসরে গেলেন তখন আমরা বিআইবিএ-এ নিয়ে গিয়ে তার দক্ষতাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিই। বিআইবিএম-এ মোজাফফর হোসেন চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই তিনি জনশক্তি উন্নয়নে বিশেষ করে কি করে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট করতে হয়, পরিবর্তন ঠিকমতো করতে হয়- তিনি ব্যাংকারদের হাতে-কলমে শেখাতেন। সুতরাং একটা ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি তার একটা প্যাসন ছিল এবং পরবর্তীকালে আমি তখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। আমিও একদিন গিয়েছি। সেখানে তিনি গ্রামের একজন কৃষককে নিয়ে আসতেন অন্যদিকে গভর্নরকে বসাতেন। বা কোনো ব্যাংকের এমডিকে বসাতেন। মুখোমুখি করে জবাবদিহি করাতেন। এখানে তিনি ব্যাংক খাতকে ঋদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্যাংক খাতের অনিয়ম অব্যবস্থা বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছেন। এগুলো তিনি আবেগ থেকেই বলেছেন, আমরা এ সেক্টরটা দাঁড় করালাম, এই সেক্টর যদি ক্ষতি হয়ে যায় সে জন্য তিনি সত্য কথা বলতেন এবং মুষ্টিমেয় মানুষ থাবা মেলেছিলেন- তিনি বুঝতে পারতেন। এতে সমবেদনা প্রকাশ করতেন।
আমি মনে করি একজন সৎ সমালোচক এ খাতের বন্ধু হতে পারে, শত্রু না। তিনি সমালোচক ছিলেন। তিনি আর্থিক খাতের বন্ধু ছিলেন। তার কথা শুনে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে সেটাই হবে তার প্রতি যোগ্য সম্মান দেখানো। তিনি যে সব নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, যে সব সমালোচনা করে গেছেন সেগুলো এড্রেস করা, তার নীতি ও নৈতিকতার সমার্থন করার দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি শুধু ব্যাংকারই ছিলেন না। তিনি সুসাহিত্যিক ছিলেন, শিশু সংগঠক ছিলেন। কচিকাঁচার মেলা তিনি পরিচালনা করেছেন। এমবিএ সমিতির সভাপতি ছিলেন। বহুমাত্রিক, সার্থক, সাধা-সিধে মানুষ ছিলেন। তার কোনো অর্থসম্পদ নেই, তিনি একেবারে সৎ ও স্বচ্ছ একজন মানুষ ছিলেন। যেমন তিনি বলতেন তেমনি তিনি স্বচ্ছ ছিলেন।
তিনি এক জীবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন, তিনটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন, চেয়ারম্যান ছিলেন- ব্যাংক খাতে এটি একটি বিরল ঘটনা!
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর ছিলেন। তিনি এক জীবনে কয়েকটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন, চেয়ারম্যান ছিলেন। এ রকম বহুমাত্রিক লিডার এবং সুনামের সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়া লিডার আর্থিক খাতে আর নেই। যে সব দায়িত্বগুলো তিনি পালন করেছেন, শেষ করেছেন, সেসব কাজের সঙ্গে তিনি বেঁচে থাকবেন। এ জন্য কতিপয় মানুষ তার কর্মকাণ্ডে অখুশিও থাকতে পারেন। কিন্তু তিনি বহু মানুষের পক্ষে ছিলেন, বহু মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।
আপনি যখন বাংলাদেশে ব্যাংকে কৃষি ঋণ নিয়ে যুগ সূচনা করলেন, সব ব্যাংককে তার মোট ঋণের ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করানোর কাজ শুরু করেছিলেন। কৃষিঋণ নীতিমালা করলেন তখন উনি আপনার কৃষি ঋণ কার্যক্রমের সমার্থক ছিলেন, প্রসংসা করতেন...
যখন আমি কৃষিঋণ নীতিমালা তৈরি করেছি তখন উনার পরামর্শ নিয়েছিলাম। সাইখ সিরাজেরও সহায়তা নিয়েছিলাম। আব্দুস সাত্তার মণ্ডল, মাহাবুব হোসেন-এঁদেরও ধারণা ও মতামত নিয়ে আমি কৃষি ঋণ নীতিমালা করেছিলাম। এটা তিনি ওন করেছেন। এ কাজ করতে তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন। কৃষককে তিনি এতই ভালো বাসতেন পরবর্তীতে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান থেকে অবসরে গেলেন তারপরও গ্রাম থেকে কৃষক ডেকে এনে টেলিভিশনে তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। কৃষকের বিপরীতে আমাদের বসাতেন।
এ রকম সাহসী, ন্যায়, পরায়ন, সৎ যোগ্য মানুষ আমাদের সমাজে খুউব বেশি নেই। বহুমাত্রিক একজন মানুষ ছিলেন। একই সঙ্গে পেশাদারি, একই সঙ্গে মানবিক ও সৎ স্বচ্ছ। সত্যি কথা বলতে ভয়হীন মানুষ আমাদের সমাজে খুবই বিরল আমাদেরই। দুর্ভাগ্য যে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খুবই চেষ্টা করেছি উনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তিন-চারদিন আগে সাড়া দিচ্ছিলেন। কোভিড নেগেটিভ হয়ে গেল, পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশনে বয়সের কারণে আর টিকিয়ে রাখা গেলো না। তিনি আমার অভিভাবকও ছিলেন, বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। আমি তার স্নেহধন্য। আমার দুঃসময়ে, সুসময়ে সব সময় তিনি আমার সঙ্গে থেকেছেন, স্নেহ করতেন।
আর্থিক খাতের শিক্ষক ছিলেন
হেলাল আহমেদ চৌধুরী
খোন্দকার ইব্রাহিমের সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন, প্রথমে ব্যাংকে তারপর বিআইবিএম-এ। তাকে কেমন দেখেছেন?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ব্যাংকিং খাতের পরশপাথর। যখন যেখানে হাত দিয়েছেন তার স্পর্শে খাটিয়ে হয়ে গেছে। তার কর্মময় জীবন অনুসন্ধান করলে আমরা এমনটাই দেখতে পাই। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে পূবালী ব্যাংকের একটি আস্থার ব্যাংকের পরিণত হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংক প্রবলেম ব্যাংক ছিল। উনার ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ব্যাংকটি প্রবলেম ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। এখানে তার বিশেষ অবদানের জন্যই সম্ভব হয়েছে বলে আমরা মনে করি। পূবালী ব্যাংক এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার মহান কর্ম-নিষ্ঠার জন্য তিনি এ কৃতিত্বের দাবিদার।
বয়সের কারণে তিনি ২০০৬ সালের পর আর পূবালী ব্যাংকে থাকতে পারেননি। ২০০৫ সালে পূবালী ব্যাংককে প্রবলেম ব্যাংকে থেকে বের আনার পর পরই ২০০৬ সালে উনার বয়স ৬৫ বছর হয়ে যায়। এ কারণে অবসরে চলে যেতে হয়। এরপর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ পূবালী ব্যাংককে সমস্যা ব্যাংক থেকে একটি ভালো ব্যাংকে পরিণত করার পর তার নির্দেশিত পথে ব্যাংকটিকে আমি আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি পূবালী ব্যাংকের এমডি হওয়ার আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে কাজ করেছি। এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি। উনাকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। কারণ আমরা প্রায়ই ট্যুরে যেতাম। সেই সুবাদে যে কোনো বিষয়ে একান্ত আলোচনা করার সুযোগ ছিল। কোনো বিষয় না বুঝলে তিনি সুন্দরভাবে সেটা বুঝিয়ে দিতেন। এতে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে উনার মধ্যে শিক্ষকসুলভ একটি সুন্দর মানসিকতা ছিল। এবং এই মানসিকতা উনাকে অনেক উচ্চ আসনে আসিন করেছেন। তিনি অনেক কঠিন কথাও অনেককে সহজভাবে বলে ফেলতে পারতেন; অপ্রিয় সত্যও বলতেন পারতেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। কখনো অন্যায়ের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেননি।
ব্যাংক সেক্টরকে অনেক সময় অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। খেলাপি ঋণ, স্ক্যাম নানা কারণে এমন অবস্থায় পতিত হতে হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে তাকে কথা বলতে হয়েছে। এ বিষয়ে উনি বিষয়টি তিনি শক্তভাবেই ড্রিল করতে পারতেন। যার ফলশ্রুতিতে পূবালী ব্যাংক ভালো ট্রাস্ট পেয়েছে। তার কারণেই আমরা সমস্যার মধ্যে থেকে বের আসতে পেরেছি। এবং পূবালী ব্যাংক উত্তর-উত্তর এগিয়েছে। এটা উনার কর্মের ধারাবাহিকতা হিসাবে আমরা মনে করি।
রাষ্ট্রায়ত্ত-বেসরকারি নির্বিশেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হাবু-ডুবু খাচ্ছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মধ্যে এমন কি ছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পূবালী ব্যাংককে সমস্যা ব্যাংক থেকে বের করে আনলেন?
প্রথম কথাটি হলো পূবালী ব্যাংকে সরকারের অনেক ঋণ ছিল। ওগুলো নেগোসিয়েশন করেছেন এবং আদায় করেছেন। দ্বিতীয়ত হলো, কর্পোরেট গভর্নেন্স নিশ্চিত করতে পেরেছেন। নতুন ঋণ যেগুলো দিয়েছেন সেগুলোও যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে-সেগুলো তিনি ভালোভাবে পরিচালনা করেছেন। পুরাতনগুলো আদায় করতে পেরেছেন। বিষয়টি নিয়ে নিজে যেমন কাজ করেছন আমাদেরও সেইভাবে পরিচালিত করেছেন। এ ছাড়া উনার মধ্যে আমরা দেখেছি ভালো ক্লায়েন্ট কিন্তু কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তিনি সাহায্য করেছেন। যারা ইচ্ছা-খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থান ছিল; সেখানে তিনি অনকম্প্রোমাইজ মনোভাব দেখিয়েছেন। সে জন্য আমরা পূবালী ব্যাংকে লোন পোর্টফলিও সুন্দরভাবে করতে পারে এবং উত্তরোত্তর এগিয়ে যেতে পারে সে জন্য তিনি সদা সতর্ক কাজ করেছেন। ২০০৫ সালে জয়েন করার পর ২০০৬ সালের মাঝামাঝি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ চলে গেলেন। ২০০৬ সালের সম্ভাবত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। এরপর আমি দায়িত্ব নিই এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০০৭ সালের পুরোপুরি খেলাপি থেকে বেরিয়ে আসি। পূবালী ব্যাংক একটি ভালো ব্যাংক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে।
ব্যাংকের এই দুরবস্থা- এ থেকে বের হতে উনার শিক্ষাকে কীভাবে কাজ লাগাতে হবে?
কোভিডের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সব সার্কুলার এসেছে সেগুলো যুগান্তকারী সার্কুলার বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার যে প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশের জন্য একটা খুবই সহায়ক সিদ্ধান্ত। এসব সিদ্ধান্ত যুযোপযোগী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটা সময়ের দাবি ছিল এবং সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার এটা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক নীতি সহায়হার জন্য কোভিডের মধ্যেও অভিঘাত মোকাবিলা করে আর্থিক উন্নয়ন ঘটছে। এর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহায়তা কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে ইচ্ছা-খেলাপির পাশে না দাঁড়াতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের যে অবস্থান বাংলাদেশ ব্যাংক সে নীতি অনুসরণ করছে। উনি মনে করতেন ব্যাংক অর্থনীতির ধারক-বাহক। ব্যাংক খাত অর্থনীতির ধারক হিসাবে যদি অর্থনীতিকে সচল রাখতে হয় তাহলে ব্যাংক খাতকে সুন্দর অবস্থানে রাখতে হবে। এবং যে সব ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে সেগুলোকে সঠিক পথে আনতে হবে।
বাইরে থেকে মনে হতো খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ব্যক্তিগতভাবে কঠিন মনের লোক। অনেকে মনে করেন উনি কঠিন মনোভাবের লোক। বাইরে কঠিন হলেও ভিতরে একটি সহজ মন ছিল। এজন্য যখন তিনি কচি-কাঁচার মেলাতে বাচ্চাদের কাছে থাকতেন তখন তিনি একজন ভিন্ন এক ইব্রাহিম খালেদ হয়ে যেতেন। যখন পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেছেন তখন আরেক ইব্রাহিম খালেদকে দেখতে পেতাম। একেবার সহজ মানুষ হিসেবে পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে মিশে যেতেন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে একজন নরম মানুষকে পাই; কোমলমতি মনের মানুষ হিসাবে দেখি। উনি খুবই সিম্পল লাইফ লিড করতেন। এই সিমপ্লিসিটি উনাকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন। উনার প্রজ্ঞা, উনার সততা, উনার সাহস উচ্চতর স্থানে জায়গায় দিয়েছে। সব মিলে উনি পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি ব্যক্তি জীবনে খুব অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। উনার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা ট্যুরে গেছি। একবার আমরা গোপালগঞ্জে গেলাম, বরিশালে আমাদের কনফারেন্স ছিল। উনি বললেন, দেখুন বরিশালে ভালো হোটেল নেই আমার বাসায় থাকতে হবে। আমি বললাম, স্যার আমার কোনো আপত্তি নেই। বরিশাল থেকে গোপালগঞ্জে গেলাম। সেখানে উনি আর আমি বঙ্গবন্ধুর মাজার জেয়ারত করলাম। উনার বাসায় ভাই থাকতেন। সেখানে থাকলাম। সেখানে খাওয়া নিজেই পরিবেশন করলেন। ব্যাংকে যে আমার বস, বাসায় তিনি অতিথি সেবা করলেন একজন চিরায়ত বাঙালির মতো। উনার কলিগের প্রতি, জুনিয়রদের প্রতি যে সহানুভূতি ছিল- একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম। ব্যক্তিকে কীভাব সম্মান করতে হয়। উনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু জেনেছি। উনার কাছে থেকে নেওয়া শিক্ষা আমার জীবনে অনেক সহায়তা করেছে। বিআইবিএম-এ আমরা স্যারকে পেয়েছি সহকর্মী হিসাবে। সেখানে আমরা পাশাপাশি রুমে বসতাম। সেখানে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ স্যারের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হতো। তিনি বার বার ব্যাংকের সুশাসন বিষয়ে খোলা মন নিয়ে আলোচন করতেন।
উনার পড়াশোনার খুব আগ্রহ ছিল। শেষ বয়সেও তিনি অনেক পড়াশোনা করতেন; আমাদেরও পড়াশোনা করতে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন জ্ঞান অর্জন করেন দেখবেন কোনো সমস্যা থাকবে না। কোথাও বাধা পড়বেন না। তার কথা আমরা সব সময় পালন করেছি। উনার সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময় সভা, সেমিনারে দেখা হতো। আলাপ হতো। বিআইবিএমএ-এর সেমিনারে, পিকেএসএফ-এ দেখা হলো। সেখানে আমাকেও যখন জেনারেল বড়িতে নেওয়া হলো সেখানেও উনাকে দেখলাম নতুন করে। উনার প্রজ্ঞার অতুলনীয়। পিকেএসএফ-এর উন্নয়ন কিভাবে ঘটানো যায় তিনি চিন্তা করেছেন, বাস্তবায়ন করেছেন, কন্টিবিউট করেছেন। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছু, অনেক সময় ধরে বলা যায়। উনি পুরো আর্থিক খাত সম্পর্কে বিরাট চিন্তা-চেতনা ছিল। আমাদের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে উনার অনেক জায়গায় গেছেন। সেখানে তিনি নানা বিষয়ে শলা-মরামর্শ করতেন। কৃষি ও পল্লীর জীবন নিয়ে উনাদের চিন্তা-ভাবনার মিল ছিল।
উনার আর একটি গুণ ছিল কোন ভুল হলে তিনি পরিষ্কার বলে দিতে পারতেন। ভুল ধরিয়ে দিতেন। সেটা আমার কর্মকর্তা-কর্মচারী হোক বা অন্য কেউ উনি সুন্দর করে বলে দিতেন। উনার এই স্পষ্টভাষী অবস্থান উনাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন। বর্তমান গর্ভনর করোনার অভিঘাত মোকাবিলার জন্য যেসব প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আলোচনা করতেন, বলতেন- এটা একটি সঠিক উদ্যোগ। উনার লম্বা ব্যাংকিং জীবনে কৃষি ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। সোনালী ব্যাংকের ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে উনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তা তিনি খুব সহজ এবং নির্ভয়ে বলতেন, কাজে লাগাতেন। তিনি ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর হিসেবে। তিনি সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনের সঙ্গে কাজ করতেন। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, নির্দেশনা তার অবর্তমানে ব্যাংক খাতের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।
প্রণোদনার ছোট ঋণ বিতরণে শেষ পরামর্শ
বড় ঋণের ৯০ ভাগ বিতরণ হয়ে গেছে; এটা ঠিক আছে। বড়দের দরকার আছে। বরং বড়দের বেশি দরকার আছে। কিন্তু ছোট যারা এসএমই সেক্টর, এসএমইএ সেক্টরে ওরা ছোট্ট; কিন্তু ওইদিকে নজর কম সবার। টাকার এখানে অভাব আছে তা না। কিন্তু ওদেরকে লোন দিতে গেলে ব্যাংকের সমস্যাগুলো তো জানি সুপারভিশন খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। ১০ কোটি টাকা বড়দের একজনকে দিলেই হয়। আর ছোটদের দিলে কয়েকশ’ লোককে দিতে হয়। এই কয়েকশ’ লোককে সুপারভাইজড করা কস্টলি হয়ে যায়। এ জন্য একই রেস্ট অব এন্টারেস্টে ছোটদের একটু অসুবিধা হয় বলে ব্যাংকাররা এটার ব্যাপারে কম উৎসাহ দেখায়। আর একটি বিষয় হলো ছোটদের খুঁজে খুঁজে বের করা মুশকিল। আর ছোটরা যা হয় বড়দের চেয়ে কম শক্তিশালী তারা ব্যাংকে পাত্তা পায় কম। সব কিছু মিলে এটা হচ্ছে।
এ জন্য জাপানে একটি পদ্ধতি আছে, এটা ভালো। বড় শিল্প যারা তাদের প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক এসএমই থাকবে। এরা বড় শিল্পের ছোট্ট পার্টসগুলো করে দেয়। এ রকম যদি হয় তাহলে বড় শিল্প যেগুলো থাকে তার রিকুয়েস্টে এই ছোট ঋণ দেওয়া যেতে পারে। তো ওই সিস্টেম আমাদের এখানে হয়নি। ওইটা যদি করা যায় এই যে এসএমই সেক্টরের ঋণ দেওয়ার সমস্যা হচ্ছে, তা ইনপ্রুফ করবে বলে আমার মনে হয়; এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আপাতত যেটা করার দরকার তা হলো বিসিককে বেশি নজর দিতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশন আছে ওদের একটু নজর দিতে পারে। তাহলে ছোট ঋণ বিতরণে যে খারাপ অবস্থা- তা একটু পিক-আপ করতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে একটু পারসু করতে হবে।