ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অর্থনৈতিক সংকট কাটানো কঠিন

জাফর আহমদ
🕐 ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০২১

অর্থনৈতিক সংকট কাটানো কঠিন

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২২ লাখ মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত প্রায় ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই মৃত্যুর সংখ্যা আট হাজার এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও মানুষের শরীরে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে চলমান কোভিড-১৯ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে প্রচলিত অব্যবস্থা-অর্থনৈতিক নীতির ফলে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মহামন্দার সৃষ্টি হয়েছে তা পুনরুদ্ধার করা শিগগিরই সম্ভব হবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত।

তার মতে, ‘২০২০ সালে আমরা একই সঙ্গে একই সময়ে দুটি মহাবিপর্যয়কারী মহারোগে আক্রান্ত হয়েছি। যাকে আমরা মোটামুটি নিরাময় অযোগ্য ‘শরীরে অনেক অঙ্গের বিকলতা’ বা ‘শরীরে অনেক জটিল রোগের বাসা’র সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এই দুই মহারোগের একটি অর্থনৈতিক-সামাজিক আর অন্যটি প্রাকৃতিক-ভাইরাস কোভিড-১৯ উদ্ভূত। যতদিন পর্যন্ত শোষণভিত্তিক-বৈষম্য পুনঃসৃষ্টিকারী মনুষ্যবিচ্ছিন্নকরণ-উদ্দিষ্ট আর্থসামাজিক সিস্টেম পুঁজিবাদ ও তার মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে, ততদিন সময়ান্তরে ‘মনুষ্যসৃষ্ট সংকট’ নামক মহারোগ হবেই। অর্থনৈতিক-সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে সংকটের উৎপত্তির কারণ হলো শোষণভিত্তিক লোভ-লালসাভিত্তিক-যে কোনো কিছুর বিনিময়ে মুনাফা সর্বোচ্চকরণভিত্তিক বৃদ্ধিভিত্তিক-নিরন্তর বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি। যে অর্থনীতিক মহামন্দার অনিবার্য যা ওই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অন্তর্গত এবং মুক্তবাণিজ্যচক্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ রোগ থেকে মুক্তি হবে সাময়িক। তবে চক্রটি যেহেতু ওই ব্যবস্থার অঙ্গ সেহেতু চক্রটি চলতেই থাকবে। এ মন্দা বা মহামন্দা থেকে উত্তরণ ঘটবে, অর্থনীতির উপরের দিকে যাবে। কিন্তু একট সময়ে আবারও মন্দা-মহামন্দা অনিবার্য। দীর্ঘমেয়াদি ঋণচক্রের হিসেবপত্তর বলে প্রতি ৪৭ বছর পরপর মন্দা রোগ অনিবার্য। আর রোগটি যদি ৪৭ বছরের বেশি পরে ঘটে তাহলে ধরে নিতে হবে যে রোগের জীবাণু অর্র্থনীতির দেহে ঘনীভূত হচ্ছে। যা পরে মন্দা রোগ থেকে মহামন্দা রোগে হিসেবে আবির্ভূত হতে বাধ্য। এই রোগের নিরাময়ে কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ নেই। যতদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থাকবে যা ওই রোগের মূল কারণ, ততদিন ‘মন্দা-মহামন্দা নামক রোগটি যাওয়া আসা করবে।’

বাংলাদেশে এই রোগ সারাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে টাকার অংকে তা এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার মধ্যে সরাসরি বড় শিল্প ও সেবা খাতের উদ্যোক্তারা নেবে। নিজেদের ক্ষতি হয়েছে- এমন মিথ্যা কথা বলে এ সব উদ্যোক্তা প্রণোদনার সুবিধা নেবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। যা অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ‘পড় পর্দায় সামাজ অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। ড. আবুল বারকাতের এ ভবিষ্যদ্বাণী ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসেই কাজে লেগেছে। সরকার ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রণোদনা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা এ প্রণোদনা পাওয়ার জন্য আবেদন ও অনুমোদন হয়ে গেছে। অথচ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ করা ঋণ, কৃষিঋণ বিতরণ নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে আরও নয় মাস যোগ করা হলেও অর্ধেক বিতরণ করা হয়নি। বার বার এ সময় বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন শর্ত পূরণ করে তারা ব্যাংকেই আসছেন না।

দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাত তুলে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যায়। বার বারই নেয়, কোনোবারই ফেরত দেয় না। এ জন্য সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে বা সরকার যন্ত্রে বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থে সরকার যন্ত্রকে ব্যবহার করে। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় যায় তখনই তারা বিভিন্ন নামে ও রঙে সরকারে মিশে যায়। আর এর মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে। ২০১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলে যারা ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা নিল পরে তারা সেই টাকা ফেরত দেয়নি। বরং নানা রকম ওজর-আপত্তি করে আবার সুবিধা নিয়েছে। ২০১৯ সালে এসে তারাই সরকারকে দিয়ে নীতি ও অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুদের হার কমিয়ে নিল। ড. আবুল বারকাত এ ধরনের ঋণ গ্রাহককে ‘ডাকিনীবিদ্যক গ্রুপ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা বিতরণ সম্পর্কে ড. বারকাত বলেন, “এ সব হিসাবপত্তর যাই হোক না কেন প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা চলে যাবে ‘বড়’দের হাতে। সেটাই আর্থিককরণকৃত পুঁজির অধীন রেন্ট-সিকার নিয়ন্ত্রিত অশোভন ব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়ম। ওরা ‘বড়রা’ ‘জোমবি বড়রা’ ‘ডাকিনিবিদ্যক গ্রুপ বা করপোরেশন’রা নেবে সবকিছু। এ সব কাজে ব্যবহার করবে সরকারের ফিসক্যাল পলিসি। অর্থাৎ আয় ও ব্যয় নীতি। মুদ্রানীতি হবে ওদের স্বার্থের অধীনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপবে, বড়রা আবারও নেবেন এবং আবার ফেরত দেবেন না। এভাবে চলতে চলতে ১০ বছর পরপর অবশ্যম্ভাবীভাবেই হবে অর্থনৈতিক সংকট। কোভিড ওদের খুবই উপকার করেছে। কোভিড-১৯ নামক উপলক্ষকে ওরা ওদের স্বার্থে অবস্থার অবনতির কারণ হিসেবে ব্যবহার করবে। ওরা মিথ্যা বলবে যে, ওদের খুব ক্ষতি হয়েছে, যা আসলে হয়নি। দেশের এই মহাবিপদকালীন এই মুহূর্তে বলেই দেখুন ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক অনুমতি দেওয়া হবে, দেখবেন আবেদনকারীর সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৫০ হাজার।”

প্রণোদনা ঘোষণা, বণ্টন ও এ সম্পর্কিত পথনকশাতে মালিকদের আচরণে সরকারের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য যখন পাঁচ হাজার কোটি টাকার মজুরিপ্রণোদনা ঘোষণা করা হলো মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হলো তাদের ব্যক্তিগত তহবিলে দেওয়া হোক তারা এ টাকা শ্রমিকদের পৌঁছে দেবে। এ সময় শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বলা হলো মালিক নয়, শ্রমিকদের সরাসরি দেওয়া হোক। রীতিমতো বাকযুদ্ধ চলল মালিকদের তহবিলে নেওয়ার জন্য। শ্রমিকদের প্রণোদনা কোনোভাবেই মালিকদের মাধ্যমে যাবে না, যাবে শ্রমিকের নিজ নিজ মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কড়া কথায় জানিয়ে দেওয়া হলো। উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সরকার অবগত থাকলেও শেষ পর্যন্ত মালিকরাই জয়ী হচ্ছে। মূলত সরকারে মালিকপক্ষের উপস্থিতি ও দর কষাকষির বেশি শক্তি থাকা এবং সাধারণ মানুষের ভয়েজ ক্ষীনকায়ের কারণে তারা উপেক্ষিত হচ্ছে।

দুই মহাদুর্যোগে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির মহাসংকটের মধ্যেও পুনরুদ্ধারের আশা ছেড়ে দিচ্ছে না দেশের শীর্ষ এই অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের মধ্যে সব সমাধান প্রত্যাশা করছেন। সামাজিক-অর্থনৈতিক ও মানবিক বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়ে বর্তমান সংকটের মধ্য দিয়ে যে দীর্ঘ সংকটের পাখা মেলেছে তার সমাধান দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক-সামাজিক অর্থনৈতিক প্রবাহ হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে কোভিড-১৯-এর বিপর্যয় থেকে মুক্তি এবং একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভবিষ্যতে সুন্দর-শোভন আলোকিত সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব। ‘কোভিড-১৯ মহামন্দা রোগ’ অর্থাৎ বিকভারি, যা স্বল্পমেয়াদের আশু করণীয়, আর আলোকিত-শোষণ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের পথ হলে জনকল্যাণকামী বৈষম্য হ্রাসমুখী প্রকৃতি সম্মানী উৎপাদনমুখী বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, যা দীর্র্ঘমেয়াদি বিষয়। তবে বৈষম্য হ্রাসকারী বিজ্ঞানমনস্ক উৎপাদনশীল প্রকৃতির শক্তিতে আস্থাশীল দীর্ঘমেয়াদের সংস্কার কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হচ্ছে কি-না, তা বহুলাংশে প্রতিফলিত হবে আশু-স্বল্পমেয়াদি আমরা যে সব উদ্ধার-পুনরুদ্ধারমূলক রিকভারি কর্মকাণ্ড করব তার চরিত্র বৈশিষ্ট্যের ওপর।’

করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে যে মৃত্যু ও আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও মানুষের শরীরে পুষ করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিসৃষ্ট এই মহাসংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। মৃত্যু ও আক্রান্তের মিছিলের মধ্যেই ভ্যাকসিন প্রয়োগের মধ্যে সে সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। নড়েচড়ে বসেছে পুরো বিশ্ব। আবুল বারকাত বলেছেন, প্রকৃতির প্রতি এত অন্যায়-অত্যাচারের পরও প্রকৃতি ক্ষমা করে দেয়। প্রকৃতি খুবই দয়ালু। কারণ আমরা মানি আর না মানি প্রকৃতি জানে যে মনুষ্যসমাজ তারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রকৃতি প্রকৃতিবলেই বিচ্ছেদ-বিচ্ছিন্নতা বিশ্বাস করে না। আর প্রকৃতি মানুষের সেই শক্তি জোগান দেয়, যা দিয়ে মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে আবিষ্কার-উদ্ভাবন দিয়ে করোনার মুক্ত বিশ্ব উহার দেবে।

 
Electronic Paper