ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হুমকিতে লিবারেল ডেমোক্রেসি

অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ

ড. কাজল রশীদ শাহীন
🕐 ১০:১৬ অপরাহ্ণ, মে ২০, ২০১৯

তুখোড় বক্তা, তীক্ষ্ণধী বিশ্লেষক হিসেবে খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। শিক্ষকতায় ধ্যানস্থ যেমন, তেমন আগ্রহ ও উদ্যোম গবেষণায়। কৌতূহল ও এষণা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া। ভূ-রাজনীতির বিশ্ববাস্তবতায় পরাশক্তিধর দেশগুলো কী করছে, কীভাবে প্রভাবিত করছে প্রতিবেশীকে-আলী রীয়াজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে ফেরেন এর তাত্ত্বিক-দ্বান্দ্বিক ও অনিবার্য বাস্তবতাকে। খোলা কাগজ সম্পাদক ড. কাজল রশীদ শাহীন-এর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সেসবের সারাৎসার

দেশের বাইরে থেকে দেশ নিয়ে ভাবনাটা কেমন?
এখন দেশের বাইরে বলে তো আপনি আলাদা কারতে পারবেন না। কারণ সারা পৃথিবীর খবরই তো এখন সহজে পাওয়া যাচ্ছে। এই যেমন আপনাদের কাগজও অন্যদের হাতে যাওয়ার আগেই দেখা হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন বাইরে থেকে দেখতে চাইলে দুটো দৃষ্টিভঙ্গি আছে। একটা হচ্ছে, একেবারে নির্ভেজাল সংখ্যা দিয়ে দেখা যেতে পারে। জিডিপির গ্রোথ। অবশ্য সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সম্প্রতি সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) পক্ষ থেকে জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

অন্যদিক থেকেও দেখা যেতে পারে, বৈষম্য বাড়ছে। দারিদ্র্য কমার হার হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অংশের যে ক্ষোভ-পাটকলের শ্রমিকদের ক্ষোভ, পোশাক তৈরি খাতে যারা আছে, শ্রমিকদের যে পরিস্থিতি, সেগুলো তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আছে পুষ্টির অভাব, যে কারণে এখন ট্যাবলেট খাইয়ে এই অভাব পূরণ করা হচ্ছে। কিংবা ধরুন কৃষকদের অবস্থা, ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখে। না হয় কৃষক তার নিজের ধান পুড়িয়ে দেবে কেন? এটা তাদের শ্রমে-ঘামে তৈরি করা জিনিস। তাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ রেমিট্যান্স। অথচ দু’চার দিন পরপরই আমরা শুনছি, মৃত শ্রমিকদের লাশ আসছে। বেকারত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। এত কিছুর পরও গ্রোথ যদি হচ্ছেই, তাহলে কার হচ্ছে? অনেক দিন ধরে শুনি বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় দেশ। সম্ভাবনা তো অবশ্যই আছে। এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে তরুণ, সুতরাং সম্ভাবনাময় তো হওয়ারই কথা। কিন্তু সেই তরুণরা কি কাজে লাগতে পারছে? বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতেই লাখ লাখ তরুণের জীবন চলে যাচ্ছে। এদের তো আরও উৎপাদনশীল খাতে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কে না জানে! এখন টাকা যারা নিয়ে গেছে, ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা তো হয়নি, উল্টো তাদের মাফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অথচ কৃষক তার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। তরুণরা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।

এই যে আমাদের নানা সংকট, বিশ্ব বাস্তবতাও কি এমনই?
অর্থনৈতিকভাবে যদি বিবেচনা করেন তা হলে বাংলাদেশের এই চিত্রটার কতগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। জাপানের সঙ্গে তো আপনি তুলনা করতে পারবেন না। কারণ জাপানের এজিং পপুলেশন, বাংলাদেশে তো তা নয়। আবার বৈষম্যের কথা ধরুন, সারা পৃথিবীতেই এই সমস্যা আছে কিন্তু বৈষম্যের যে মাত্রা সেটা আমাদের দেশে অনেক বেশি। এখানে মধ্যবিত্ত ধনিক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, এটা অন্য দেশেও হচ্ছে কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার যে ব্যবস্থা, সেটা এখানে অনুপস্থিত। অন্যান্য দেশে এমন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, যেখানে সর্বনিম্ন আয়ের ব্যক্তিও কোনো না কোনোভাবে টিকে থাকার ব্যবস্থা তৈরি করছে, সেটা করছে রাষ্ট্র। এখানে কোথায় সেটা?

সামনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ সময় এসে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা-সব কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে?
আমি প্রশ্নবিদ্ধ বলব না। আমি বলব, পঞ্চাশ বছরের মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছু অর্জন করার কথা ছিল, যা হয়নি। কোনো অর্জন হয়নি তা বলছি না, নিঃসন্দেহে হয়েছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি হওয়ার তো কথা ছিল। স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। কোথায় সেটা? তারপর দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত হব বলেই তো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। বাইশ পরিবারের শাসন-শোষণের বদলে আমরা চেয়েছিলাম সাম্য। পঞ্চাশ বছরে সেটা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? ফলে পঞ্চাশ বছরের উদযাপনের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো করতে হবে। উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। এখন রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি আছে, এখানে সেই পথ খোঁজার উপায় কী? অংশীদারিত্বের রাজনীতি যেখানে থাকবে না সেখানে অংশীদারিত্বের অর্থনীতি কীভাবে তৈরি হবে?

আমাদের দেশে অংশীদারিত্বের রাজনীতির চর্চা কি ছিল কখনো?
’৯০-পরবর্তী সময়ে সম্ভাবনাটা তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি ছিল, চেষ্টা ছিল। কিন্তু আপনি যদি চেষ্টাটা অব্যাহত না রাখেন, তা হলে তা হঠাৎ করে তৈরি হয়ে যাবে না। এখন সেই চেষ্টাটাই তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। ফলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য আদর্শকে তো আপনি জলাঞ্জলি দিতে পারেন না। সমাজে যে বড় রকমের অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে এর কারণ হলো মানুষ এখন আর কোনো আশ্রয়ের জায়গা পাচ্ছে না।

এ অবস্থার পেছনে কি রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী, নাকি আমাদের সমাজব্যবস্থায় ত্রুটি আছে?
সমাজ তো একটা হোমোজেনাস বিষয় নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন রকম চিন্তা, চেতনা, বিভিন্ন রকম স্বার্থ-সংঘাত থাকবে-সেটাই স্বাভাবিক। সেগুলোকে সম্মিলিত করে অগ্রসর হওয়ার দায়িত্বটা রাজনীতির; রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সেই জায়গায় ব্যর্থতাটা দেখতে হবে। ফলে রাজনৈতিক দলকে আলাদা করে চিহ্নিত করার চেয়ে, মোটা দাগে রাজনীতিকে অভিযুক্ত করার আগে বোঝা দরকার বাংলাদেশের এখনকার যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যে অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে-ত্রুটি ওই জায়গায়। যেটা আমি বলছিলাম, সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক অংশীদার যতদিন না করতে চান, ততদিন পর্যন্ত এটা এমনিতে তৈরি হবে না। যারা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখুন, তারা কি এই অংশীদারিত্বের রাজনীতির কথা বলছেন? অংশীদারিত্বমূলক রাজনীতির জন্য কতগুলো ন্যূনতম বিষয় আছে, সেগুলোই তো অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছে। তাই শুধু সংস্কৃতিকে অভিযোগ করলে তো চলবে না। সংস্কৃতি, রাজনীতি-সবকিছু মিলেই তো অগ্রসর হবে।

আগে বাংলাদেশকে নিয়ে সুপার পাওয়ারগুলোর একটা ইন্টারেস্ট ছিল। কিন্তু ইদানীং সেই ইন্টারেস্ট কমে গেছে বা ইন্টারেস্টটা একমুখী হয়ে গেছে...
বাংলাদেশের বরং ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে। কারণ অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র তো এখন এশিয়ায়। এখানে একটি বৈশ্বিক শক্তি আছে, সেটা হলো চীন। আরেকটা হলো, আঞ্চলিক শক্তি, যার বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার আকাক্সক্ষা আছে। তারা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। আগে যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের উপস্থিতি ছিল তা অনেকটাই কমে গেছে, সীমিত হয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ হচ্ছে সাউথ এশিয়া এবং সাউথইস্ট এশিয়ার ব্রিজ-সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের বে অব বেঙ্গল হচ্ছে ইন্ডিয়ান ওশেন বা ভারত মহাসাগরের এক্সটেনশন। ইন্ডিয়ান ওশেন নিয়ে তো এখন বড় রকমের টানাপড়েন চলছে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে আগের তুলনায় বৈশ্বিক আগ্রহ তৈরি হয়েছে আরও বেশি।

তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থানটা কি কৌশলগত?
না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের আসলে ক্ষমতারই হ্রাস ঘটেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের যে শক্তি, সেটা কেবল সামরিক নয়, খানিকটা নৈতিক এবং আদর্শিকও বটে। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছরে সেই জায়গা থেকে অনেক পিছিয়ে এসেছে, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের কারণে। বুশ চলে যাওয়ার পর ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের সেই শক্তিকে খানিক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী সময় ট্রাম্প প্রশাসন তার ঠিক উল্টো পথে যাওয়া শুরু করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন অনেকটা ‘একলা চলো’ নীতির মধ্যে চলে গেছে। বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ বলে ‘মেক আমেরিকা অ্যালোন এগেইন’-এর দিকে চলে গেছে। তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিপত্তি কমেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা জানি, তাদের সিস্টেমটা ডেভেলপ হয়ে গেছে। সুতরাং ওবামা বা ট্রাম্প-কে ক্ষমতায় আছে, সেটা মুখ্য না। তাহলে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এমনটা হলো কেন?
প্রতিষ্ঠানগুলোর যে শক্তি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তার পাশাপাশি প্রেসিডেন্টেরও ক্ষমতা আছে, যার কখনো অপপ্রয়োগ হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প আসার পর অপপ্রয়োগটা হচ্ছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে হলেও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের মধ্যে যে কর্তৃত্ববাদী চরিত্র দেখা গেছে, সেটা অন্যদেশে হলে যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াত, যুক্তরাষ্ট্রে তার তুলনায় অনেক কম। সেটা ক্ষমতার ব্যালেন্সের কারণে।

যেমন গত হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের ইলেকশন, সেখানে ডেমোক্র্যাটরা আসার কারণে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। দুই বছর পর আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিতও হন এবং অন্যদিকে কংগ্রেস যদি ডেমোক্র্যাটদের হাতে আসে, তাহলে ক্ষমতাগুলো আরেকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। ওদের ওখানে একটা ব্যালান্স আছে-প্রেসিডেন্টের কোনো ক্ষমতাই নেই, এমন নয় আবার প্রেসিডেন্ট চাইলেই সবকিছু করতে পারেন তাও না। তাছাড়া সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট তো আছেই।

যুক্তরাষ্ট্রের এই একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব হওয়ার বিষয়ে সে দেশের সিভিল সোসাইটির প্রতিক্রিয়াটা কেমন?
বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য কমছে। এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। এখন যুক্তরাষ্ট্র তাকে পরিবর্তন করে, বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে, কীভাবে ভূমিকা পালন করবে-সেটাই দেখার বিষয়। সেটা হুট করে বা অকস্মাৎ বের করা যাবে না।

ওবামা প্রশাসন সেই চেষ্টাটা করেছিল কিন্তু ট্রাম্প এসে অন্যপথ ধরেছেন। তিনি মনে করছেন, একাই আমি শক্তি দেখিয়ে জয় করতে পারব। সামগ্রিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের মত হচ্ছে, আমাদের সব বিষয়ে সংযুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেসব জায়গায় প্রয়োজন, সেখানে আমরা যেন একা না থাকি। এই দুটো জিনিস কিন্তু পরস্পরবিরোধী না। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা একাই করব, আর কারও প্রয়োজন নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের এই আপদকালে রাশিয়া ও চীন কোন দিকে যাচ্ছে?
রাশিয়া তার শক্তি বৃদ্ধি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু চীন অন্য একটা নীতি গ্রহণ করেছে। আসলে চীনের প্রধান লক্ষ্য শুধু অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হওয়া নয়। চীনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা খুব স্পষ্ট। চীন এটা প্রমাণ করতে চায়, লিবারেল ডেমোক্রেসি (উদার গণতন্ত্র) ব্যর্থ। সে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিতে ব্যর্থ এবং কাঠামোগতভাবে এটা কার্যকর নয়। তাহলে বিকল্প কী? বিকল্পটা চীন উপহার দিতে চায়। আমি বলব, সেটা এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী, একচ্ছত্র শাসনের মডেল।

এই কর্তৃত্বটা কি খুব সাইলেন্ট?
আমি তো খুব স্পষ্টভাবেই দেখতে পাই। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়ার অন্য যে কোনো দেশই হোক-যেখানেই চীন যাচ্ছে, একটা বড় আকারের টাকার থলি নিয়ে হাজির হচ্ছে বটে কিন্তু এক্ষেত্রে তার লক্ষ্য কেবল বাণিজ্য নয়। যেখানেই সে গেছে সেখানেই তার কর্তৃত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীন তাদের বলছে, এসব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে তুমি উন্নয়ন করতে পারবে না।

আমাদের ক্ষেত্রেও তারা বোধহয় এমনটা ভেবেছিল?
এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না। চীন যেখানেই গেছে এই ধারণা থেকেই কাজ করেছে। তারা বলার চেষ্টা করেছে, পশ্চিমা উদার গণতন্ত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উপহার দিতে পারে না এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত যে দিকগুলো আছে, তা খুব কার্যকর নয়। তো আসেন, আমরা ভিন্ন একটা পথ খুঁজে বের করি। সেটা কী? সেটা হলো তাদের কর্তৃত্ববাদী মডেল।

সেক্ষেত্রে আমাদের প্রতি তাদের ইন্টারেস্ট এখন আরও বেশি?
অবশ্যই। দুটো কারণে। একটা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার প্রভাবটা বাড়াতে চায়। তারা যেহেতু ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্ত, ফলে তারা মনে করে, যেখানে পা রাখতে পারবে, সেটাই তাদের জন্য ভালো। পরবর্তীতে সেসব জায়গায় আরও বিস্তরভাবে পা রাখতে পারাটা তার জন্য সহজ হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের মডেলটা তারা যেখানে যতটা গ্রহণযোগ্য করাতে পারবে ততটাই তাদের জন্য ভালো। সেটা করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে যতটা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যায় ততটাই বেঁধে রাখবে।

চীন তো তাহলে রাশিয়াকে অনেক কাছের মনে করে?
অবশ্যই। কারণ চীনের মডেলটা হুবহু কপি না করলেও রাশিয়ার মডেলটা তার প্রায় কাছাকাছি। তারাও কর্তৃত্ববাদী শাসনে বিশ্বাসী। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় তো আছেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই কর্তৃত্ববাদী শাসন অনেক বেশি স্পষ্ট। এটা এই কারণে যে, এখানে প্রত্যক্ষভাবে সে ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত।

ভারতের সঙ্গে চীনের এই দ্বন্দ্বটা কি অনেকটা বাই বর্ন...
হ্যাঁ, একার্থে তাই। এটা জিওগ্রাফিক্যাল প্রক্সিমিটির কারণে, পাশাপাশি থাকার কারণে। ভারতের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়া হচ্ছে তার ব্যাকইয়ার্ড। এখানে সে অন্য কোনো শক্তির প্রভাব দেখতে চায় না। অতীতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অ্যালাউ করেছে, কারণ ততদিন পর্যন্ত তার ওই শক্তিটা ছিল না। এখন যেহেতু ভারত সেই শক্তি অর্জন করেছে, অন্তত তারা মনে করছে, তাদের সেই শক্তি অর্জিত হয়েছে, সেই সক্ষমতাটা তৈরি হয়েছে, তাই তারা সুযোগটা আর দিতে চায় না। অতীতেও ভারত চেষ্টাটা করেছে। নেপাল-মালদ্বীপ-শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা দেখেন, তারা সব সময় এটা চেয়েছে।

নিজের বলয়ের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর এবার বলল, ‘নেইবার ফার্স্ট’। নিজের বলয়ের মধ্যে আনার এটা একটা পদ্ধতি। আপনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও করতে পারেন, চোখ রাঙিয়ে করতে পারেন আবার বন্ধুত্বের বেষ্টনী দিয়েও গ্রহণ করতে পারেন। ভারত বন্ধুত্বের বেষ্টনী দিয়ে গ্রহণ করতে চেষ্টা করছে না, এই জায়গায় চীন একটা সুযোগ পাচ্ছে। চীন মনে করছে, তাহলে আমিই বন্ধুত্বের বেষ্টনী নিয়ে এগিয়ে যাই।

এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকে কারণ তার ওই লেভেলের অর্থনৈতিক শক্তিটা আছে, যেটা ভারতের নেই। চীন যত সহজে কুড়ি বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে ফেলতে পারে, প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, ভারত সেটা পারছে না। তদপুরি চীনের আছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প। এর মাধ্যমে এশিয়া এমনকি এশিয়ার বাইরের দেশগুলোকেও যুক্ত করতে পারছে। এর মাধ্যমে তারা আর্থিক এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্টের কথা বলছে।

তাহলে পলিটিক্যাল ফিলোসফির জায়গায় চীনই এই মুহূর্তে এগিয়ে আছে?
প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা আছে। চীন একটা মডেল উপহার দিচ্ছে। অবশ্য বলে কয়ে দিচ্ছে না, আগে যেমন মাও-সেতুংয়ের চিন্তার কথা বলা হতো, সেভাবে বলছে না। কিন্তু কথাবার্তাগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে আপনি তা দেখতে পাবেন। চীন কিন্তু বলবে না-এটা আমার মডেল। বা বলবে না যে পৃথিবীব্যাপী লিবারেল ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে আমি একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।

পৃথিবীজুড়ে লিবারেল ডেমোক্রেসি যে সংকটের মধ্যে পড়েছে, তার অভ্যন্তরীণ কারণ আছে। বিভিন্ন দেশে এর চর্চার মধ্য দিয়ে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, আছে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা। কিন্তু তার পাশাপাশি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীন এবং রাশিয়া লিবারেল ডেমোক্রেসিকে কোনো না কোনোভাবে অকার্যকর বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে সব সময়। এটাকে আমরা বলব ‘অথরিটেরিয়ানিজম’ গণ গ্লোবাল। মনে রাখা দরকার, লিবারেল ডেমোক্রেসির সংকটাটা এই প্রথম না। তিরিশের দশকে আমরা এই সংকট দেখেছি। সিকলিক্যাল মডেল সেটা আবার ফেরত এসেছে। কিন্তু এখন সংকটটা এত বড় হয়ে উঠল কেন? অতীতে আদর্শিকভাবে উদার গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জটা এসেছে ফ্যাসিবাদের কাছ থেকে, নাৎসিবাদের কাছ থেকে কিংবা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মডেলের কাছ থেকে। অথচ তখন এত বড় সংকট হলো না, এখন যতটা সংকটের মুখে। এর কারণ অর্থনৈতিকভাবে চীনের শক্তি অর্জন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে অ্যাসল্ট অন লিবারেল ডেমোক্রেসি ফ্রম রাশা অ্যান্ড চায়না।

চীন কি তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে নাকি কাউকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করছে?
দক্ষিণ এশিয়ায় তার চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে ভারত, এটা তো পরিষ্কার। আর বহির্বিশ্বে যেখানে আমেরিকার ইনফ্লুয়েন্স আছে সেখানটায় আমেরিকা। কোথাও কোথাও সে রাশিয়াকেও চ্যালেঞ্জ মনে করে, যখন তার স্বার্থের জায়গাটা সামনে আসে।

যেমন ধরুন আফ্রিকায়, গোটা আফ্রিকা মহাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এক সময় পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে শোষণ করেছে, কার্যত আফ্রিকা আবার সেই শোষণচক্রে পড়েছে। শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর জায়গায় এখন চীন উপস্থিত।

আরেক ফর্মে আবার উপনিবেশবাদের সূচনা?
নয়া উপনিবেশবাদের যে বৃত্তচক্রের মধ্যে এক সময় আফ্রিকা ছিল, এখন আবার প্রায় সেই জায়গায় এসে পড়েছে।

এর ভেতর দিয়ে কি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে?
কিছু লোকের হচ্ছে। যে কোনো দেশেই যখন এ ধরনের ইনভেস্টমেন্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট হয় তখন তো তার বেনিফিশিয়ারি থাকবেই। ওই বেনিফিশিয়ারিগুলোই মূলত দেখা যায়।

(চলবে)

 

 
Electronic Paper