ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমি রুটিন উপাচার্যের বাইরে

ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী

সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০১৯

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন সান্ধ্যকালীন কোর্স, উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি শিক্ষক ঘাটতি, পিএইচডির মান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্নের কথা বলেছেন খোলা কাগজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজ্জাদ হোসেন

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটির বিচার না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে...
বিচার হয়নি এ ধারণাটি একেবারেই ঠিক নয়। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ঘোষণা করেছি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য অভয়ারণ্য। মেয়েদের সচেতন করার জন্য আমরা হলে হলে ক্যাম্পেইন করেছি। এখানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি সরকারি কমিটি রয়েছে। যে কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের প্রতিনিধি আছেন। কমিটি নানাভাবে ক্যাম্পেইন ওয়ার্ক করেছে। মেয়েদের র‌্যাগিংয়ের নামে হয়রানি করায় ১১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছি। বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি বিরল। যৌন নির্যাতনবিরোধী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি যার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে আমি সেই আলোকে ব্যবস্থা নিয়েছি।

সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিল করা হয়েছিল, সম্প্রতি আবার চালু হয়েছে। এর কারণ কী?
বর্তমান সিলেবাসে আমরা সেমিস্টার সিস্টেম চালু করেছি যেটা অতীতে ছিল না। এখন কোয়ালিটি এডুকেশন এনশিউর করতে হলে সেমিস্টার সিস্টেমে আসতে হবে। এর ফলে বছরে একটির জায়গায় দুটি পরীক্ষা নিতে হয়। তা ছাড়া কোর্সের সংখ্যাও বাড়ে ফলে শিক্ষকের সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া কিছু কিছু বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। তখন আমি বিষয়টা একাডেমিক কাউন্সিলে তুলি, সেখানে সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে শিক্ষক সমিতির এক সভায় যে যে কারণে বাতিল করা হয়েছিল সেসব লেকিংস পূরণ সাপেক্ষে আবার সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার দাবি আসে। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চপর্যায়ের একটি মাননিয়ন্ত্রক কমিটি তৈরির মাধ্যমে আবারও সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করা হয়েছে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি এখন কেমন?
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় গত ১০ বছরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিজেও ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড, চীন সফর করেছি। কিছুদিন পর আবারও চীনে যাব উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে। বর্তমান সরকারের উচ্চশিক্ষা পলিসির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান সরকারের উচ্চ শিক্ষা পলিসি অনেক ভালো। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনের ছোঁয়াটা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও লেগেছে। আমরা হেকেপ (হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট) পেয়েছি এবং এর মাধ্যমে অনেক বিভাগে ল্যাব এবং আধুনিক আইসিটি বেসড এডুকেশন প্রবর্তন করেছি। আমার সময়কার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, ২২টি বিভাগে ‘সেলফ অ্যাসেসমেন্ট’ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। প্রত্যেক কমিটিতে একজন করে বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিল যারা আমাদের রিপোর্ট রিভিউ করেছে এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। সবমিলিয়ে অতীতের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আর বর্তমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

সান্ধ্যকালীন কোর্সের ব্যাপারে শিক্ষকদের যে আগ্রহের কথা বলা হয়, এটা শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেই বর্তমানে একটা কমার্শিয়ালিটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কীভাবে অন্য জায়গায় দুটো ক্লাস নিয়ে বাড়তি ইনকাম করবে তারা সেটা ভাবেন। আর্থিক সচ্ছলতাকে যদিও অস্বীকার করা যায় না কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বর্তমান সরকার যেভাবে বেতন বাড়িয়েছে তাতে শিক্ষক সমাজের এমনটা না করলেও চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই এমন পার্ট-টাইম ক্লাসের প্রতি ঝুঁকতে দেখা গেছে। ৫০ বছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সত্যেন বোস, স্যার জগদীশ চন্দ্র। তাদের কিন্তু পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ছিল না, কিন্তু তাদের সৃজনশীলতার কারণে বিশ্বব্যাপী তাদের পরিচিতি ছিল। আসলে কর্পোরেট পুঁজিবাদী সমাজের একটা নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষক সমাজের ওপরও পড়েছে।

আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কি পর্যাপ্ত?
কর্মকর্তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক ও কর্মচারীর ঘাটতি রয়েছে। বিভাগগুলো পরিচালনার জন্য প্রচুর শিক্ষক, অফিস সহকারী, গার্ড, পিয়ন, ক্লিনার প্রয়োজন। আমি ইউজিসিতে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে চাহিদাপত্র দিয়েছি এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। এখানে সরাসরি কর্মচারী নিয়োগে একটু জটিলতা রয়েছে। তবে শিগগিরই এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে আমি আশা করছি।

শিক্ষক ঘাটতির কারণে পড়াশোনার মানের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি?
তা তো কিছুটা হয়ই। তবে যারা বর্তমানে নিয়োজিত আছেন তারা অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সংকটকে আপাতত পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর মানের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলব আগের চেয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান এখন অনেক ভালো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর সন্তোষজনক সহকারী জজ থেকে শুরু করে বিসিএসসহ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেকগুণ ভালো করছে। আমরা আন্তর্জাতিক ফোকলোর সম্মেলন করেছি। এমন কোনো সপ্তাহ নেই, যে সপ্তাহে দেশ-বিদেশের কোনো শিক্ষক এখানে আসেন না।

পিএইচডির সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মান কমছে...
এই অভিযোগের কিছুটা সত্যতা আছে। হঠাৎ করেই এমফিল, পিএইচডির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। এর রাশ টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছি। এক্ষেত্রে বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন এবং আন্তর্জাতিক মান অর্ডিনেন্স করা হয়েছে। এর ফলে গতবারের পিএইচডি ভর্তি তথ্য অনুযায়ী ১০ ভাগেরও বেশি প্রার্থী শর্তই পূরণ করতে পারেনি। পিএইচডি যিনি করবেন, যিনি করাবেন উভয়ের যোগ্যতা পরিমাপ করা, ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা, একই বিষয়ে আগে কেউ কাজ করেছে কিনা তা শনাক্ত করার মাধ্যমে এমফিল, পিএইচডির মান নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি।

দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন?
আমি রুটিন উপাচার্যের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিদিন নতুন কিছু করতে চাই। গত আড়াই বছর সময়কালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশ কিছু অগ্রগতির সূচনা করতে পেরেছি। যদি আমি আবার সময় পাই তাহলে আরও ভালো কিছু করে দেখাব। এত কিছুর পরেও আমি বর্তমানে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে খুব একটা আহ্লাদিত নই। আমার টার্গেট হচ্ছে একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা। যেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখাপড়া চলবে, গবেষণা চলবে, জ্ঞান বিতরণ, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে। একটা সময় এমনও হতে পারে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রোল মডেল।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
খোলা কাগজ পরিবারের জন্য শুভকামনা।

 
Electronic Paper