ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পুরস্কার মানদণ্ড নয়

অসীম সাহা

শিমুল জাবালি
🕐 ১:০৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯

কবি অসীম সাহা। ভাষা ও সাহিত্যে ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এ বছর পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’। পুরস্কার এবং কবিতার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন শিমুল জাবালি

বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘একুশে পদক’ পেলেন। এতে আপনার কী মনে হচ্ছে? সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা বেড়ে গেল নাকি দীর্ঘদিনের যে চর্চা তারই অর্জনের ফসল...
আমার আসলে এসবের কিছু মনে হয় না। কবি হিসেবে কবির দায়িত্ব হলো অবিরাম লিখে যাওয়া। কে পুরস্কার দিল কে দিল না, এটা যদি দায়িত্বের মাপকাঠি হয় তাহলে তার পক্ষে কবি বা লেখক হওয়া মুশকিল। অনেকে বলেন, পুরস্কার নতুন লেখা লিখতে অণুপ্রাণিত করে, পুরস্কার যদি অণুপ্রাণিত করে, তাহলে কবি বা লেখকের নিজস্ব কোনো অণুপ্রাণন নেই? পুরস্কার দিলে কেন অণুপ্রাণিত হবে! এ তো ভয়ঙ্কর কথা! পুরস্কার পেলে আমার আনন্দ লাগতে পারে, উৎসাহ পেতে পারি, কিন্তু অণুপ্রাণিত কীভাবে হয় জানি না। কবিতা তো প্রতি সেকেন্ডে নিজের ভেতর অণুপ্রাণিত হবে। আমি চিরকালই অণুপ্রাণিত ছিলাম, এখনো অণুপ্রাণিত, তবে কোনো দায়বোধ আমার নেই।

এটা কি বাহাদুরি কথা?
না, কোনো বাহাদুরি কথা নয়। পুরস্কার পেয়ে আমি আনন্দিত শুধু। আর কিছুই না।

তাহলে কি পুরস্কার পাওয়ার পর কবি হিসেবে সফল মনে হয়?
তাও না। এমন অনেক বিখ্যাত লেখক আছেন যারা কোনো পুরস্কার পায়নি। কিন্তু যারা পেয়েছেন তাদের চেয়ে কি বড় লেখক নেই পৃথিবীতে?

হ্যাঁ, দস্তয়ভোস্কি, তলস্তয়সহ অনেকেই...
তাহলে এরা ছোট লেখক নাকি? কবির সবচেয়ে বড় মানদ- তিনি নিজে। পুরস্কার এক প্রকার স্বীকৃতি। ভালো লিখতেন না খারাপ লিখতেন এসব এখানে দাঁড়ায় না। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রভাব ইত্যাদি। যার কারণে লেখার বিষয়বস্তু আড়ালে থাকে। অতএব পুরস্কার কোনো সাহিত্যের মানদ- হতে পারে না।

আপনার দিকে আসি। দীর্ঘদিন সাহিত্য চর্চার পরও বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০। অথচ আপনার সমসাময়িকদের একশ এমনকি দুইশ ছাড়িয়েও। এর কারণ কী?
এ কয়টা বইয়ের কারণে কম যে লিখেছি তা নয়। লিখেছি প্রচুর। প্রকাশ করেছি কম। বেছে বেছে। সবসময় চেষ্টা করেছি ভালোটা প্রকাশ করার। পাঠক বলতে পারবে কতটুকু সফল হয়েছি। শেষ কবিতার বই লিখেছি ২০১৫ সালে আর ২০১৬-তে আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছি সে বইয়ের ওপর। তখন সরকারি চাকরি করছিলাম। খুব যন্ত্রণায় ছিলাম। ৯ মাসে লিখে শেষ করি। বেছে বেছে ৩৬টা কবিতা নিয়ে বই করেছিলাম। গত সাড়ে তিন বছর কোনো কবিতা লিখিনি। একটা কাজ করছিলাম। বাংলা সাহিত্যের প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ বড়–চণ্ডীদাশের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’র অনুবাদ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের তো বাংলায় ভাবার্থ পাই। আপনি করতে গেলেন কেন আবার?
হ্যাঁ, তবে সেটা গদ্য আকারে। কিন্তু আমি পরিশিষ্ট থেকে শুরু করে ১৪ খণ্ড কবিতা থেকে কবিতায় রূপান্তর করেছি। আদি ভাষা থেকে বর্তমান ভাষায় রূপান্তর করেছি, যে ছন্দ যেভাবে আছে সেভাবেই। সবকিছু করতে আমার পাঁচ বছর সময় লেগেছে।

এটা করার উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্য হলো, বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যকে সহজে বোঝা। সাধারণ পাঠকের কাছে মূল ব্যঞ্জনা পৌঁছে দেওয়া। আরেকটা কারণ আছে, শ্রীকৃষ্ণকে এখানে দেবতা হিসেবে ট্রিট করা হয়েছে। তিনি যে একজন মানুষ ছিলেন, তার যে কাম, ক্রোধ ছিল এবং রাধিকাও যে মানুষ ছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ আর রাধিকার মধ্যে যে শারীরিক মিলন হয়েছিল তারই বর্ণনা করেছেন চণ্ডীদাশ। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের ধর্মীয় রূপের বাইরে যে মানবিক রূপ রয়েছে তা জানানোই ছিল উদ্দেশ্য।

ভাষান্তর করতে গিয়ে ব্যাকরণগত সমস্যা, বানান বিভ্রাট, বাক্য বিন্যাসের সমস্যায় পড়েননি? আমাদের তো নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ নেই।
পড়েছি। সে জন্য আমি বানান নিয়েও কাজ করেছি। ‘আধুনিক ব্যবহারিক সহজ বাংলা অভিধান’ নামে একটি পুস্তক শিগগিরই প্রকাশিত হবে। নিজস্ব ব্যাকরণ না থাকার কারেণ অনেক সমস্যা হচ্ছে। যা কিছু বই আছে বানান এবং ব্যাকরণ সম্পর্কিত সেসব নিয়েও মানুষ বিব্রত। একেক বইতে একেক রকম। তাই এসব সহজ করার জন্য ৩৭ হাজার শব্দ থেকে বাছাই করে মাত্র ১০ হাজার শব্দ নিয়ে এ অভিধানটি বের করতে যাচ্ছি। দেখা যাক, কতটুকু সফল হই।

আপনার কবিতায় প্রেমের আধিক্য কেন? কিন্তু এখনকার কবি-পাঠকরা তো প্রেমকে ন্যাকা মনে করে। কবিতার দুর্বলতা ভাবা হয়।
প্রেমের বিকল্প কি আছে আর! তুমি দেখবে পৃথিবীর যত বড় কবি আছে সবাই প্রেমকে গুরুত্ব দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশকে যে এত পছন্দ করি, কেন? প্রেমের জন্যই তো। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সবার আগে কিন্তু ওই বনলতা সেনের কথাই বলবে। কেন করছে? অন্তরে লাগে বলে। এ আকুতি সবার ক্ষেত্রেই অনন্য। নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম কিংবা পুরুষের প্রতি নারীর প্রেমকে ক্ষুদ্রকায় দেখার সুযোগ নেই। সত্যিকার অর্থে প্রেমের চোখে তাকাতে পারলে তা থেকে আলাদা সৌন্দর্য প্রকাশিত হবে। বোদলয়েরের মতো বোহেমীয়াম কবি বলে গেছেন, ‘প্রিয়তমা সুন্দরীতমা হে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার, অমৃতের দিব্য...’ (বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে)। নর-নারীর প্রেমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক কারণে রাজনৈতিক কবিতা লিখেছে, সেটা সময়ের প্রয়োজনে। আর আমি যখন নীরবে-নিভৃতে একা বসে আছি তখন আমার ভেতর প্রেম ছাড়া কিছু আসে না।

ষাট-সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। তখন যে প্যাটার্নে যেভাবে কবিতা লিখত সবাই। এখনো কেন সে রকমই লেখেন আপনারা? কবিতার তো অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পাঠরুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক, উত্তরাধুনিক, অত্যাধুনিক এরকম কত কি আমাদের সামনে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তারও পরিবর্তন ঘটে। আমরা ব্যক্তিগত সংঘাত, সম্ভাবনা, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদির ভেতর দিয়ে যাই। সে কারণে অনুভূতিরও নানা রকম পরিবর্তিত হয়, চিন্তারও ব্যতয় ঘটে। নব্বই দশকে এসে তরুণরা একটা ট্রাম নেওয়ার চিন্তা থেকে এগিয়ে আসছিল। সেটা হচ্ছে, উত্তরাধুনিক কবিতা। কিন্তু মুশকিল হলো, যে উত্তরাধুনিকের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে একশ বছর আগে, আমেরিকাতে। প্রথম আসে ফরাসি ভাস্কর্য থেকে। তারপর আমেরিকার দুই গবেষক কবিতার ভেতরেও এ আভাস দেখতে পান। তখন তারা বলেন, আধুনিকতার দিন শেষ, অনন্ত আধুনিকতার দিকে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু সেটা তেমনভাবে লিখে কেউ দেখাতে পারেনি। কলকাতায় সত্তরের দশকে এ নিয়ে শ্রুতি আন্দোলন করেছেন কবিরা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরী, সমর রায়চৌধুরী, অঞ্জন সেন, বিনয় মজুমদারসহ অনেকেই ছিলেন। তাদের নেতা ছিলেন অমিতাভ গুপ্ত। অমিতাভ গুপ্ত কিছু কবিতা লিখে দেখাবার চেষ্টা করেছেন, ‘এ হলো উত্তরাধুনিক কবিতা।’ কিন্তু সেসব কবিতা আধুনিকতার বাইরে যেতে পারল না। ফলে উত্তরাধুনিকতাকে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশেও ‘স্বাক্ষর গোষ্ঠী’ একই ধরনের আন্দোলন করেছিল, তারা বলেছে জীবন অর্থহীন, একে সিগারেটের মতো পান করতে করতে উড়িয়ে দাও। তারাও কিন্তু দেখাতে পারেনি। রফিক আজাদ তোলপাড় সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যেখানে যৌনতাগন্ধী উপাদান বেশি ছিল। সেখান থেকেও তারা মূল শ্রোতে ফিরে আসে। ওই পুরনো ধ্যান-ধারণাটি, যেটা অবশিত হয়ে গেছে সত্তরের দশকে সেটাই নব্বই দশকে নিয়ে আসা হলো। যারা করেছে তারা একটা ভুল ধারণার ওপর আছে। তুমি দেখো তারা কোথায়? তারা গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিজস্ব ঘরানা কী?
বাংলা কবিতার নিজস্ব ঘরানা লিরিক্যাল অথবা রোমান্টিক। তা আমাদের লোকধারা। এই নিজস্ব সংস্কৃতি বিচ্যুত হলেই বিপদ। ত্রিশের দশকের যে পঞ্চপা-ব, তার মধ্যে জীবনানন্দ সবচেয়ে বেশি গৃহীত হলো কেন?

কিন্তু জীবনানন্দকে তো ইউরোপীয় ঘরানার বলা হয়...
তা কেন! তিনি ইউরোপীয় ছায়া নিয়েছেন, কিন্তু ধারাটা বাংলার। আমাদের প্রকৃতি, জীবন সবকিছু তার কবিতায় চলে আসছে। আর বাকি চারজন এখন তো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমরা পশ্চিমের ধারাটাকে অন্ধ অনুকরণ করে যাচ্ছি যেটা কোনোদিনও গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের সমাজকে অনুভব করতে হবে।

আবারও আপনার দিকে আসি। জীবনসায়েহ্নে আছেন। কোনো আক্ষেপ বা না পাওয়া আছে?
আমার তেমন কোনো আক্ষেপ নেই। শুধু কষ্ট হয় আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ যে চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে আমরা নেই। সেখান থেকে সরে যাওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে মূল্যবোধের বিচ্যুতি ঘটেছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যকিছু প্রত্যাশা করা ভুল হবে।

তাহলে রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতি কি কবির দায়বোধ নেই?
তা আছে। সেটা ভিন্ন অর্থে। বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বোধ আছে। এমন নয় যে আমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল-মিটিং করতে হবে, সমাজের দানশীল ব্যক্তি হতে হবে। একজন রাজনৈতিক নেতা যা করবে কবি কেন তা করবে। প্রকৃতপক্ষে কবি চেতনার কাছে দায়বদ্ধ, শারীরিক দায়বদ্ধ নয়। ন

 
Electronic Paper