নারী নিরাপত্তায় পঞ্চায়েত
সুরঞ্জন তাম্বুলি, নয়াদিল্লি
🕐 ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৭, ২০২০
ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এক তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে নয়াদিল্লির সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের বিচার দাবিতে সমাবেশে প্রায় অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। বিক্ষোভের ঢেউ লাগে সারা দেশে। ভারতের সর্বত্রই সৃষ্টি হয় নারী নির্যাতন বিরোধী গণজোয়ার।
অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাসেবীরা এগিয়ে আসেন আর শুরু হয় সচেতনতামূলক কর্মতৎপরতা। এর ফলে নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে নয়াদিল্লিতে রিপোর্ট করার সংখ্যা বেশি বেড়ে যায়।
লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণত নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা থানায় অভিযোগ আকারে দেওয়া হতো না। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
ধর্ষণের অভিযোগ করার সংখ্যা বেড়ে গেছে। মূলত, শহরাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা পুলিশকে অবহিত করা হয়ে থাকে বেশি। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করা হয়েছে নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে প্রচার মাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অব্যাহত প্রচারাভিযানের ফলে অনেক সচেতন হয়ে উঠছেন মহিলারা। তারা নির্যাতনের কথা থানায় বলে দিচ্ছেন।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর উপাত্তে দেখা যায়, পুলিশও তাদের তদন্ত কাজে কিছুটা হলেও উন্নতি করেছে। ২০১২ সালে পুলিশ ধর্ষণের মামলার ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশের তদন্ত করেছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশে।
ভারতের আদালতে নারী নির্যাতনের প্রায় তিন কোটি ১০ লাখ মামলা স্তূপ হয়ে আছে। তাই মামলা নিষ্পত্তি হতে দেরি হচ্ছে। যদিও এখন ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার আদালত গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা চাপাই থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যান নির্যাতিতা মহিলারা। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে কেরালা রাজ্যের আলাপুজহা জেলার একটি পঞ্চায়েত। তাদের লক্ষ্য মহিলাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তাদের অনুসরণ করে অন্য অনেক জায়গায় এবং খোদ নয়াদিল্লিতে গঠিত হয়েছে মহিলা পঞ্চায়েত। নয়াদিল্লিতে প্রতি বুধবার বসে মহিলা পঞ্চায়েত সভা। নির্যাতিত নারীরা এখানে তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন এবং পঞ্চায়েত বিচারের ব্যবস্থা করে।
কেরালা রাজ্যের আলাপুজহায় সর্বপ্রথম পঞ্চায়েত এই চেষ্টা শুরু করে ২০১১ সালে। সে সময় কয়েকজন নারী বৈঠকে বসে সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। নারীরা তাদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনার কথা তুলে ধরলে পঞ্চায়েত এ ব্যাপারে একটি জরিপ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বেশির ভাগ মহিলা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। কেউ হন মৌখিকভাবে, কেউ হন শারীরিকভাবে।
কেরালায় মারারিকুলাম দক্ষিণ গ্রামে পঞ্চায়েত নারীবান্ধব ২৩টি কমিটি গঠন করে দেয়। এই কমিটিগুলোর কাছে নারীরা তাদের অভিযোগের কথা জানান। যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে অভিযোগ করা যেতে পারে, অভ্যন্তরীণ (বড়ির ভেতর) সহিংসতা ও গালিগালাজ থেকে যৌন নির্যাতন পর্যন্ত।
অভিযোগ গ্রহণ করা হলে প্রথমে অভিযুক্ত লোকটিকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে এ ধরনের কাজ না করার উপদেশ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ ধরনের কাজ করলে তাকে উপস্থিত হতে বলা হয় জাগ্রত সমিতির সামনে। সেই সঙ্গে সাবধান করে দেওয়া হয় তাকে। অভিযুক্ত ব্যক্তি তৃতীয়বার এ ধরনের কাজ করলে থাকে থানায় নেওয়া হয়।
এ ধরনের কমিটি গঠন করায় নারীরা স্বস্তি বোধ করছেন। কমিটিগুলোর তৎপরতার কারণে পরিস্থিতি মোড় নিয়েছে ভালোর দিকে। এখন নারীদের সমস্যার কথা বলার মতো জায়গা হয়েছে।
পুলিশও বলছে যে, পঞ্চায়েত সদস্যরা নিজেরাই এ ধরনের কয়েকটি বিষয়ের সমাধান করেছেন। নারীদের ওপর নির্যাতন যখন বেড়ে যচ্ছিল তখন তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় পঞ্চায়েত। তারা যেমন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তেমনি প্রতি ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর নজরও রাখে। ফলে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ কমে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে প্রতিটি পঞ্চায়েত এগিয়ে এলে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি কমে যাবে।