ভারতীয় হিসেবে গর্বিত নই
কাশ্মীর প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন
ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১০:৪১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৯
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের বিষয়ে কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তার মতে, গণতন্ত্র ছাড়া কোনোভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এছাড়া, একজন ভারতীয় হিসেবে গর্বিত নন বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্বখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
অমর্ত্য সেনের কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনি এমন এক সময়ে ভারতে এলেন যখন দেশটি কঠিন সময় পার করছে। কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আপনি সারাজীবন সাম্যের কথা বলেছেন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সাম্যের কথা। কিন্তু, সাম্য বলতে আমরা সবক্ষেত্রেই সাম্যকে বুঝে থাকি। আপনি কি মনে করেন- কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা সেই অঞ্চলে শান্তি এবং সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারবে?
উত্তরে অমর্ত্য বলেন, না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, কাশ্মীর একটি বিশেষ সমস্যাপ্রবণ অঞ্চল। কাশ্মীরের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমি মনে করি না যে, কাশ্মীরের জননেতাদের কথা না শুনেই আপনি সেখানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। সেখানে হাজার হাজার জননেতাকে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি, বড় বড় নেতারাও কারাগারে রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, কাশ্মীরে যেভাবে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সাফল্য আসতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকার সবসময়ই আলোচনার মাধ্যমে এগোয়। এখন সরকার যখন বলে তারা শুধু পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করবে তখন আমি মনে করি না যে সরকার সত্যিই গণতন্ত্রের জন্য কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়। আমি মনে করি না যে, গণতন্ত্র ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে। এ নিয়ে তো অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
সরকার বলছে তারা কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য অভিযান চালাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?
অমর্ত্য সেন বলেন, এটি হচ্ছে পুরনো ঔপনিবেশিক মানসিকতার অজুহাতমূলক বক্তব্য। ব্রিটিশরা যখন এখানে শাসন করেছে আমি আমার শৈশবের কথা বলছি, আমি মাঝে মাঝেই আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশরা বলতো তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য তাকে কারাগারে রেখেছে। এসব ধরপাকড়ের মাধ্যমে সেই ঔপনিবেশিক যুগে ফিরে যাওয়া হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে আমার অনেক আত্মীয়স্বজনকে জেলে পোড়া হয়েছিল।
এটি বলা সহজ যে আমরা এই মানুষগুলোকে কারাবন্দি করেছি, কারণ তারা সমস্যা তৈরি করছে। এই যে সেদিন মানুষের অধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ করা কানাইয়া কুমারকে জেলে পাঠানো হলো। যুক্তি কী ছিল? যুক্তি ছিল যে সে রাষ্ট্রদ্রোহী। সরকারের সঙ্গে মতের বিরোধিতা হলেই তা হয়ে যায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
সরকার বলছে, সাধারণ কাশ্মীরিরা ৩৭০ ধারা থেকে কোনো উপকার পাচ্ছিল না। আর দিল্লিতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার বিপুল ভোটের মাধ্যমে সেই ধারাটি বিলোপ করেছে। এ বিষয়টি নিয়ে আপনি কী বলবেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেনের বক্তব্য, ব্রিটিশরা যখন ভারত শাসন করছিল তখন আমি মনে করি, বিষয়টি ব্রিটেনে অনেক জনপ্রিয় ছিল। একই বিষয় ভারতের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তারা কাশ্মীরে কতটুকু জনপ্রিয়? বলা হচ্ছে কাশ্মীর ভারতের অংশ। কিন্তু, এ বিষয়ে কাশ্মীরের জনগণ কী ভাবছেন? এ বিষয়ে কাশ্মীরের জনগণের মত নিতে হবে তো। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে যাচ্ছে। এই সে বিপুল জনসমর্থন আসলে তা কী, আমাদের ভাবতে হবে। এই জনসমর্থন এবং মানুষের অধিকারের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে।
সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা সংবলিত ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি যে শুধুমাত্র সব মানুষের অধিকার বজায় রাখার বিরোধিতা করেছে তা নয়, এই পদক্ষেপে সংখ্যাগরিষ্ঠের কথাও ভাবা হয়নি।
৮৫ বছর বয়সী নোবেলবিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, গোটা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আদর্শ অর্জনের জন্য এত কিছু করেছে ভারত। তবে এখন আর আমি একজন ভারতীয় হিসেবে এই সত্য নিয়ে গর্বিত নই যে ভারতই গণতন্ত্রের পক্ষে প্রথম প্রাচ্যের দেশ ছিল। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, তাতে আমরা সেই খ্যাতি হারিয়ে ফেলেছি।
কাশ্মীরে দুর্বৃত্তের আচরণ করছে মোদি সরকার : অরুন্ধতী রায়
‘কাশ্মীরিদের সঙ্গে মোদি সরকার দুর্বৃত্তের আচরণ করছে। জম্মু-কাশ্মীরকে সুবিশাল বন্দিশিবিরে রূপান্তর করা হয়েছে।’ এমন মন্তব্য করেছেন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী এবং স্বনামধন্য লেখক অরুন্ধতী রায়। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে বুকারজয়ী উপন্যাসিক এই দাবি করেন। তিনি আরও দাবি করেন, ‘কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করে কুরুচিপূর্ণ পন্থায় তা উদযাপন করছে ভারত।’
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ‘নীরবতাই সব থেকে জোরালো আওয়াজ’ শিরোনামের নিবন্ধে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, ‘ভারত যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের ৭৩তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে, তখন ছিন্নমূল শিশুরা দিল্লির রাস্তায় থমকে থাকা যানবাহনের পাশে গিয়ে গিয়ে বড় মাপের জাতীয় পতাকা ও স্যুভেনির বিক্রি করছে। সেগুলোতে লেখা ‘মেরা ভারত মহান হে’ (আমার ভারত মহান)। সত্যিকার অর্থে ‘আমার ভারত মহান’-এ কথাটা এ মুহূর্তে অনুভব করতে পারা কঠিন। কারণ আমাদের সরকারের কর্মকা- দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন দুর্বৃত্তে পরিণত হয়েছে।’
নিবন্ধে অরুন্ধতী রায় আরও লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ প্রথা অনুযায়ী টেবিল চাপড়ে আইনটি পাস হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে ভারতের পার্লামেন্ট। রাজ্যটির আইনি স্বীকৃতি বাতিল করার অর্থ হলো অনুচ্ছেদ ৩৫(এ)ও বিলুপ্ত করা; এর আওতায় এতদিন কাশ্মীরি বাসিন্দাদের অধিকারের স্বীকৃতি ছিল এবং নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই ছিল। সুতরাং ‘ব্যবসায়ের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে’ এ কথাটির মানে স্পষ্ট করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ইসরায়েলি ধাঁচের বসতি স্থাপন ও তিব্বতের ধাঁচে জনসংখ্যা স্থানান্তরের মতো বিষয়গুলোও।’
গত ৮ আগস্টের (কাশ্মীর অচলাবস্থার চতুর্থ দিন) কথা স্মরণ করে অরুন্ধতী লিখেছেন, ‘এ দিন নরেন্দ্র মোদি মূলত উদযাপনমুখর ভারত ও অবরুদ্ধ কাশ্মীর নিয়ে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। বক্তব্যে তিনি বুঝিয়েছিলেন কিভাবে কাশ্মীরে আবারও বলিউড চলচ্চিত্রের শুটিং করা যাবে।’
ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিভিন্ন নারীবিদ্বেষী বক্তব্য এবং ‘কাশ্মীর থেকে ভারতীয়রা এখন মেয়ে এনে বিয়ে করতে পারবে’-হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টারের এমন বিতর্কিত মন্তব্যসহ নানা কুরুচিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের ঘোষণা উদযাপন করেছে ভারত। এ বিষয়ে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, ‘এসবের মধ্যেও সবচেয়ে জোরালো আওয়াজটি হলো কাশ্মীরে টহলকৃত ও ব্যারিকেডে ঘেরা রাস্তা এবং সেখানকার অবরুদ্ধ, নির্যাতিত, কাঁটাতারে ঘেরা, ড্রোনের নজরদারিতে থাকা এবং পুরোপুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে বসবাসকারী প্রায় ৭০ লাখ কাশ্মীরির নিথর নীরবতা।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের ‘বিশেষ অধিকার’ কেড়ে নেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পার্লামেন্টে পাস হয় একটি বিলও। আর গত ৯ আগস্ট রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত হয় তা। এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরজুড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। ইন্টারনেট-মোবাইল সেবা বন্ধ রাখাসহ গ্রেফতার করা হয় সেখানকার বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতাপন্থি ও ভারতপন্থি রাজনৈতিক নেতাকে।