মোদির সামনে যত চ্যালেঞ্জ
তুষার রায়
🕐 ১০:৫৫ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯
নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্য দিয়ে কার্যত বিরোধীদের সাফ করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। শুরু হয়েছে মন্ত্রিসভা গঠনের তোড়জোড়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, হিমালয় থেকে আরব সাগরের পাড় সবখানেই মোদির বিজেপি জোটের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।
বিরোধী দলগুলোকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেও মোদি সরকারের জন্য আগামী দিনগুলো যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে তা বলাই বাহুল্য। কারণ যেসব আশায় জনগণ তাকে সমর্থন দিয়েছে তা পূরণ রীতিমত দুঃসাধ্য। বিশাল দেশটি আর্থিকভাবে সম্প্রতি খুব স্বস্তিতে নেই, বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। রাজ্যে রাজ্যে জাতিগত বিভাজন, কর্মসংস্থান ঘাটতি, কাশ্মীরে অস্থিরতার
সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চোখ রাঙানি। পাকিস্তানের সঙ্গে চিরবৈরী সম্পর্কের সঙ্গে রয়েছে বিশে^র পরাশক্তি চীনের চোখরাঙানি। ট্রাম্পের মতো ক্ষ্যাপাটে বন্ধুকে সামলানোর পাশাপাশি পুতিনকে আশ্বস্ত রাখার দায়ও থাকছে মোদির। রাম মন্দির ইস্যুতে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এনআরসির মতো গোলমেলে বিষয়েও তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সামলাতে হবে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের (আরএসএস) নানা আবদার। আবার বিশ্বে ভারতকে আরও শক্তিশালী অবস্থান দেখাতে হবে তাকে। সব মিলিয়ে অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগামী পাঁচটি বছর কাটাতে হবে মোদিকে। এগুলো সঠিকভাবে মোকাবেলা করাই তার চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা অর্জন মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। চিরশত্রু পাকিস্তান ও মহাশক্তিধর চীনকে ঠেকাতে এসব দেশের সমর্থন ও সহযোগিতা ভারতের খুব দরকার। কিন্তু এসব দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তেমন আস্থাপূর্ণ নয়। ছোট প্রতিবেশী ভুটান এখন ভারত নির্ভরতা কাটাতে চাইছে। দেশটি ক্রমশ চীনের প্রতি ঝুঁকছে। কিন্তু চীনকে ঠেকাতে ভুটানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ভারতের জন্য জরুরি। আরেক প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। তবে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে তিস্তা চুক্তিসহ বেশ কিছু ইস্যুতে কার্যকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায় ভারতের রয়েছে। তা না হলে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক হোঁচট খেতে পারে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা নরম গরম। দ্বীপরাষ্ট্রটি ক্রমেই চীনের দিকে ঝুঁকছে। সেখানে ভারতবিরোধী মনোভাব জোরালো হচ্ছে। চিরমিত্র নেপালও বেসুরো গাইছে। তারাও আর ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। নেপালকে বাগে আনাও মোদির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া আফগানিস্তানে ভারতের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। মিয়ানমারে প্রচুর চীনা বিনিয়োগ আসছে। সব মিলিয়ে প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জনে আরও বেশি কিছু করতে হবে মোদিকে।
নিজ দেশে বিভাজনের মুক্তি
২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন বেড়েছে। মুসলিম, খ্রিস্টানসহ সংখ্যালঘু মানুষের আতঙ্ক বেড়েছে। মাত্রা ছাড়াচ্ছে গোরক্ষকদের তান্ডব। সরকারি সংরক্ষণ সুবিধা দিয়ে ভাগ করে ফেলা হচ্ছে অনগ্রসর শ্রেণিকে। বাড়ছে ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজন। রাজস্থান, হরিয়ানা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও এসব বিভাজনের রাজনীতি ক্ষমতার মূল নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। ধর্মের জিকির এতটাই তীব্র যে, উদার আদর্শিক বামদলগুলোও ভারত থেকে মুছে যাচ্ছে। এটার রাশ টানতে ব্যর্থ আখেরে তা মোদির জন্যই বুমেরাং হবে।
সুপার পাওয়ারের আকাক্সক্ষা
নরেন্দ্র মোদি ভারতকে সুপার পাওয়ার হিসেবে দেখতে চান। এজন্য আগে দরকার জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ। কিন্তু চীনের বিরোধিতায় বিষয়টা থেমে গেছে। ভারত চায় পরমাণু সাপ্লায়ার্স গ্রুপের এলিট ক্লাবে যোগ দিতে। এখানেও বাধা চীন। এছাড়া দেশটি অস্ত্র উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তারা অস্ত্রের জন্য আমেরিকা, রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। সুপার পাওয়ার হতে চাইলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী হতে হয়। কিন্তু এখনো ভারতীয় জনগণের মাথাপিছু দৈনিক গড় আয় মাত্র সাড়ে তিন ডলারের মতো। জিডিপিও সাত-সাড়ে সাত শতাংশের মধ্যেই ঘোরে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশটির সামরিক ও আর্থিক প্রভাব সুপার পাওয়ারের পর্যায়েও নয়। এসব অতিক্রম করে সুপার পাওয়ার ভারত গড়া মোদির পক্ষে বিশাল চ্যালেঞ্জ।
চীনের সঙ্গে টক্কর
চিরবৈরী পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগ থাকলেও দেশটির সবচেয়ে বড় টেনশন চীন। এই দুই দেশের সঙ্গে ভারতের বিশাল সীমান্ত ও ঐতিহাসিক তিক্ততা রয়েছে। চীন রকেটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় ভারত সনাতনী গতিতে এগোচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন বৈশ্বিক উদ্যোগে বাগড়া দিচ্ছে চীন। কিন্তু তাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো একক সক্ষমতা এই মুহূর্তে ভারতের নেই। ‘চেকবুক’ কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের বিশ্বস্ত প্রতিবেশী ও মিত্রদের বাগে আনছে চীন। দু’দেশের সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি। ফলে চীনের সঙ্গে টক্কর দেওয়াও কঠিন কাজটি মোদিকে করে দেখাতে হবে।
কৃষক সমস্যা ও বেকারত্ব
মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশসহ বেশ কয়েকটি কৃষিপ্রধান রাজ্যে কৃষক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা। ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সেচ, বীজ সারের জোগান ঠিক না থাকা, কৃষিঋণ মওকুফ না করাসহ বিভিন্ন কারণে নাজেহাল কৃষককে সুরক্ষা দেওয়া মোদির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
আঞ্চলিক বিভেদ নিরসন
বিশাল ভারতবর্ষে এক রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের আছে বিভিন্ন বিরোধ। এগুলো সামাল দেওয়া রীতিমতো দুরূহ। কিন্তু এই কাজটাই করতে হবে মোদিকে। কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষের আস্থা অর্জন, সেখানে বেকারত্ব দূর করে যুব সম্প্রদায়কে হিংসার পথ থেকে ফেরানো একটা বড় কাজ। এদিকে মোদির প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেখানকার বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার ও ৩৭০ ধারা বিলোপ করা। এটা করলে কাশ্মীরে ফের আগুন জ্বালার ভয় রয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা চাইছে। ওডিশাও এই সুযোগ চায়। রামমন্দির ইস্যু দেশটির অন্যতম বড় সমস্যা। এ মামলার চূড়ান্ত শুনানি চলছে। রায় কি হবে, রায় পরবর্তী পরিস্থিতি কি হবে সেদিকে নজর রয়েছে গোটা দেশসহ বিশ্ববাসীর। এটা নিয়েও মোদির কপালে ভাঁজ বাড়বে। এছাড়া পশ্চিবঙ্গের দাবি রাজ্যের দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ মওকুফ করুক কেন্দ্র। কাবেরি নদীর জলবণ্টন নিয়ে আন্তঃরাজ্য বিবাদ রয়েছে। এ রকম অনেক আঞ্চলিক সমস্যা উতরাতে হবে মোদিকে।
ব্রুট মেজরিটি
বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় শরিকদের পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এই সুবিধার রাশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ বেগ পেতে হবে মোদিকে। কারণ আরএসএস পাকিস্তানে হামলাসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুতে আরও আক্রমণাত্মক ভূমিকা চাইবে তার কাছ থেকে। ফলে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে এত বড় বড় সমস্যার সমাধান নরেন্দ্র মোদি কীভাবে করবেন তার ওপরই নির্ভর করবে তার সাফল্য।