ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভারতে ফের মোদি ঝড়

কুন্তল দে
🕐 ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০১৯

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আরও বিপুল বিক্রম নিয়ে জয়ী হলো নরেন্দ্র মোদির বিজেপি জোট। বলা যায়, এককভাবে মোদি ম্যাজিকে আস্থা রেখেছেন ৯০ কোটি ভোটারের ভারত। তার হিন্দুত্ববাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মিশেলে ক্যারিশম্যাটিক মোদি ঝড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে কংগ্রেসসহ বিরোধী শিবির। সাত দফায় ৩৮ দিনের নির্বাচন শেষে গত ১৯ মে বুথফেরত জরিপেই আভাস মিলেছিল নিরঙ্কুশ জয় পাচ্ছে গেরুয়া শিবির মানে এনডিএ জোট। কিন্তু বাস্তবিক ফলাফল সেই আভাসকেও হার মানাল। দিল্লির মসনদে ‘ফের একবার মোদি সরকার’।

মোদিকে ঠেকাতে একাট্টা হয়েও হালে পানি মিলল না বিরোধীদের। কারণ ৫৪৫ আসনের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও ইউপিএ জোট এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দল মিলিয়ে যেখানে ২০০টি আসনও পায়নি সেখানে বিজেপি এককভাবে পাচ্ছে ৩০০টির মতো আসন। আর শিবসেনা, আরএসএসসহ মিত্রদের নিয়ে গঠিত এনডিএ জোট মিলিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩৪৯ আসন। গতবারের চেয়েও ভালো ফলাফল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ম্যাজিক ফিগার পেতে যেখানে ২৭২ আসন দরকার হয় সেখানে তাদের অর্জন ২৮টি আসন বেশি। মূলত, ভোটের এ লড়াইটা হয়েছে মোদির সঙ্গে ভারতের সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর। এই লড়াইয়ে শুধু মোদি জেতেননি তিনি ছুঁয়ে গেছেন ভারতের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ড। দেশটির নির্বাচনী ইতিহাসে এর আগে পরপর দুইবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ও অটল বিহারি বাজপেয়ি। মোদি ঝড়ে এমনকি নিজেদের পারিবারিক আসন উত্তরপ্রদেশের আমেথিতে হেরে গেছেন কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী। যদিও কেরলের একটি আসনে জয় পেয়েছেন তিনি।

ভূমিধস জয় পেয়েই সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে উচ্ছ্বসিত নরেন্দ মোদি বলেছেন, ভারত আবারও জিতে গেল। গতকাল বিকালে এক টুইটে তিনি বলেন, ‘আমরা বেড়ে উঠেছি একসঙ্গে, সমৃদ্ধি এনেছি একসঙ্গে, একসঙ্গে থেকেই আমরা শক্তিশালী ভারত গড়ব, যা হবে সবার জন্য। ভারত আবারও জিতে গেল।’ মূলত, জাতীয়তাবাদের এই ট্রাম্পকার্ডই মোদির রাজনৈতিক মন্ত্র।

এদিকে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। গতকাল বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘জনগণ পরিষ্কারভাবে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। জনতার রায় শিরোধার্য। আমি পষ্ট করে বলতে চাই, জনগণই দেশের মালিক।’ উত্তরপ্রদেশের আমেথিতে তিনি বিজেপির স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে গেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী স্মৃতিকে অভিনন্দন জানিয়ে রাহুল বলেন, আশা করি-তিনি আমেথির মানুষকে দেখে রাখবেন। আমি সবার পাশে আছি। কংগ্রেসের যে কর্মীরা প্রাণপণ দলের জন্য কাজ করেছেন তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা।

মোদি ও বিজেপির দ্বিতীয় দফা বিজয় উদযাপন করতে গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। এ জয় উদযাপনের জন্য ২০ হাজার নেতাকর্মী জড়ো হন। উপস্থিত নেতাকর্মীরা গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহকে অভিনন্দন জানান। এ সময় জনতার উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি ভারতবাসীর যে দায়দায়িত্ব তা বিশ^কে স্বীকার করতে হবে। দেশবাসীকে আমার প্রণাম। এই ফকিরের ঝোলা তারা পূর্ণ করে দিয়েছেন।’ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও এবার শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।

কয়েক মাস আগেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। বিরোধী শিবিরের আশা ছিল, এই তিন রাজ্যে বিজেপির ফল ব্যাপক খারাপ হবে। কিন্তু তিন রাজ্যে কার্যত ২০১৪ সালের ফলের চেয়ে খুব একটা হেরফের হয়নি। তামিলনাড়–, পাঞ্জাব আর কেরল বাদে ভারতজুড়েই ফের গেরুয়া ঝড়। আর সেই ঝড়ে বেসামাল হিন্দি বলয় থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার-ওডিশা, এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো। এককভাবে বিজেপি আগের বারের ২৮২ টপকে গেছে। এনডিএ জোটও টপকে গেছে আগেরবারের ৩৩৭ আসন। অন্যদিকে বিরোধী শিবিরে শুধুই হতাশা। ভোট গণনার প্রবণতায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, কংগ্রেসের আসন সংখ্যা বাড়লেও সরকার গঠনের ধারে-কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই ইউপিএ জোটের। চন্দ্রবাবু নাইডু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়বতী-অখিলেশরা যে জোট গড়ার চেষ্টায় ছিলেন, নিজেদের রাজ্যেই শোচনীয় ফল তাদের। পশ্চিমবঙ্গে এক ধাক্কায় আসন বেড়েছে বিজেপির। উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি ৫০টির বেশি আসন পেয়েছে। আর অন্ধ্রে তেলেগু দেশম পার্টিকে হটিয়ে ব্যাপক উত্থান জগনমোহন রেড্ডির ওয়াইএসআরসিপি। শোচনীয় এ পরাজয়ে বিরোধীদের হয়ে দুতিয়ালের দায়িত্ব পালন করা চন্দ্রবাবু নাইডু পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

বিরোধীদের কাছে কার্যত তুরুপের তাস ছিল উত্তরপ্রদেশ। কারণ, আসন সংখ্যার নিরিখে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই রাজ্যে দীর্ঘদিন বাদে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি বহুজন সমাজ পার্টি এবং সমাজবাদী পার্টি এক হয়ে ভোটে লড়েছে। সঙ্গে ছিল অজিত সিংহের আরএলডিও। কিন্তু তাতেও ফল আশানুরূপ নয় বললেই চলে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির ৭১টি থেকে আসন কমলেও ৫৬টি আসন পেয়েছে জোটটি। আর বিরোধী জোটের ঝুলিতে ২৪টি আসন। এ রাজ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১টি আসন।

বিরোধী জোটের অগ্রগণ্য মুখ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ রাজ্যে ব্যাপক আসন কমেছে তৃণমূলের। সেই জায়গায় উঠে এসেছে বিজেপি। ২০১৪ সালে যেখানে ২টি আসন ছিল তাদের এবারের নির্বাচনে সেখানে পেয়েছে ১৮টি আসন। ওডিশাতেও বিজু জনতা দলকে বিরাট ধাক্কা দিয়ে ব্যাপক ভালো ফল করেছে বিজেপি। উত্তরপূর্ব ভারতেও একচেটিয়া জিতেছে বিজেপি। এ ছাড়া বিহারে বিজেপি-জেডিইউ-আরএলএসপির জোট কার্যত বিরোধীদের সাফ করে দিয়েছে। ঝাড়খ-েও প্রায় একই অবস্থা।

বিজেপি বা এনডিএ জোটের এই বিরাট সাফল্যের সমীকরণ কী? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, কারণ একাধিক। প্রথমত, অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করলে হিন্দি বলয়ে বিজেপির ভোটবাক্সে ব্যাপক ধসের ইঙ্গিত থাকলেও তা হয়নি। দ্বিতীয়ত, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে নিজেদের আসন ধরে রেখেছে বিজেপি ও তাদের সহযোগী দলগুলো। উত্তরপ্রদেশসহ হিন্দি বলয়ে যে সামান্য সংখ্যক আসন কমেছে, সেই ক্ষতি মেরামত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, বিহারের মতো রাজ্যে। দাক্ষিণাত্যে বিজেপি কখনই শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু এবারে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানায় ভালো করেছে এনডিএ জোট। এ সবকিছুর যোগফলেই ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো।

বিজেপি জোটের এই জয়ের পেছনে বিশ্লেষকরা নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমাকে সবচেয়ে এগিয়ে রাখছেন। বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাসের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা এই ফলাফলের মধ্যে দিয়ে অটুট রইল। তিনিই বিজেপির পক্ষে তিনিই যে ভোট টানেন সেটা আবারও প্রমাণ হলো। বিজেপিকে ভোট দেওয়া মানেই তাকে ভোট দেওয়া-মোদির এই মন্তব্য কার্যকর হয়েছে, তা ভোটের ফলাফলেই প্রমাণিত।’

তার মতে, সাংগঠনিক দক্ষতা, যোগাযোগের সব ধরনের আধুনিক প্রক্রিয়া ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে বিজেপি দল হিসেবে শক্তি অর্জন করেছে, তা এখন অতিক্রম করা যে খুবই কঠিন, যার প্রমাণ ভোটের প্রচারে মিলেছে। তিনি বলেন, ভোটের প্রচারে বিজেপি যেভাবে অত্যন্ত কৌশলীভাবে জাতীয়তাবাদ, উন্নয়ন এবং ধর্মীয় মেরুকরণ নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তার বিপরীতে বিরোধী দলগুলো কার্যকর বক্তব্য হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে।

 
Electronic Paper