তৃণমূলের দুর্গে বিজেপির হানা
ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০১৯
সারা ভারতে যখন চলছে মোদি ঝড় তখন তার দমকা পশ্চিমবঙ্গে এসে লাগবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে দমকাটা এত জোরে আসবে সেটা কষ্মিনকালেও ভাবেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চরম আত্মবিশ্বাসী মমতা কয়েক দিন আগেও নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন, ২ আসন থেকে ‘জিরো’-তে এসে ঠেকবে বিজেপি। কিন্তু সে অঙ্ককে মিথ্যা করে দিয়ে ২ আসন থেকে ১৬ আসনে উঠে এলো মোদির দল। সত্যিকার অর্থে এটা ভাবাটও দুঃসাধ্য ছিল ‘দিদি’র পক্ষে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে যেমন ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে বড় চমক তেমনি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের দুর্গে বিজেপির সন্তর্পণ অধিষ্ঠান আরও বড় চমক বলেই মনে করা হচ্ছে। নিজের দুর্গে মোদির এমন বিক্রমোচিত হানা রীতিমতো হতবাক করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
মমতার এমন অবাক হওয়ার পালা শুরু হয়েছিল অবশ্য বুথফেরত জরিপ থেকে আসা ফলাফলের পর থেকেই। কারণ সেখানেই এমন আভাস মিলেছে-বাংলায় অভাবনীয় উত্থান ঘটতে যাচ্ছে বিজেপির। বিজেপি সভাপতি জানিয়েছিলেন, বাংলায় বিজেপি এবার ২৩ আসন পাবে। কেউ কেউ আরও এক-দুই আসন বাড়িয়ে জরিপের ফল দিয়েছে। জরিপের এসব ফলাফল আসার পর থেকে অত্যন্ত পরিমিত প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন মমতা। মুখ খোলেননি তৃণমূলের অন্যরাও। অন্যদিকে বিজেপির একের পর এক নেতা দাবি করছিলেন, বাংলার মানুষ ‘শান্তি এবং নিরাপত্তা’র পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
গতকাল যখন গণনা চলছিল তখন বোঝাই যাচ্ছিল ইভিএম গণনার পরে ভিভিপ্যাট মিলিয়ে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করতে গভীর রাত লেগে যাবে। কিন্তু দুপুর নাগাদই অনেকটা নিশ্চিত কারা জিতছেন। ওই অবস্থায়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে টুইটারে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘জয়ীদের অভিনন্দন। কিন্তু যারা হেরেছেন, তারা সবাই হারেননি। আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তার পরে আমরা আমাদের মতামত আপনাদের জানাব।’
সদ্য সমাপ্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস জিতেছে ২৫, বিজেপি ১৬ এবং কংগ্রেস ১ আসন। রাজ্যে তৃণমূলের আসন ছিল ৩৪টি। সেখান থেকে এবার ৯টি আসন হারাতে হয়েছে। কংগ্রেস ৪টি আসন থেকে একটিতে নেমেছে। বামদের হাতে থাকা সর্বশেষ দুটি আসনও হারাতে হয়েছে এবার। গোটা ভারতে শুরু হওয়া গেরুয়া ঝড়ের প্রভাব বাংলায় এভাবে কেন পড়ল- শেষতক তার ফলাফল কী হতে পারে তার নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। ‘গো-কূলে’ বেড়ে ওঠা এই বিজেপিই অদূর ভবিষ্যতে তৃণমূলের শেষ ঘণ্টা বাজায় কি না, সে আশঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনিকি বিভিন্ন সমীক্ষা তুলে ধরে ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় জেতার সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির।
ভোটের হিসাবে তৃণমূলকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে বিজেপি। তৃণমূল যেখানে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে সেখানে বিজেপি পেয়েছে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বামেদের। মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে তিন দশকের বেশি সময় শাসন করা বামেরা।
ভারতীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছিলেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। বামপন্থীদের প্রভাবে সেটা এত দিন সামনে আসতে পারেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। তাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দিকে একটা সমর্থন ছিলই। কিন্তু ‘জনসংঘে’র ব্যর্থতা হলো স্বাধীনতার পরে তারা এটাকে কাজে লাগাতে পারেনি- বিশেষত দেশভাগ, উদ্বাস্তুদের সমস্যা- এসব ইস্যুকে তারা সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। যে কাজটা করতে পেরেছিলে কমিউনিস্টরা।
মানুষের একটা বিরাট অংশের সমর্থন তাই কমিউনিস্টদের দিকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে কমিউনিস্টরা বিদায় নেওয়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলেন। বিজেপিকে পেয়ে তার দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন তারা। মূলত, এ করাণেই ক্রমাগত বিজেপির ভোট বেড়ে চলেছে। একদিকে বাম ও কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়, অন্যদিকে বিজেপির দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে সামনে উঠে আসা- এটাকেই বিশ্লেষকরা এখন পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজনৈতিক ট্রেন্ড বলে মনে করছেন।