স্বাস্থ্যসেবায় ভারত পাকিস্তান নিচে
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, মে ২৬, ২০১৮
বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মান আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় এমনটাই বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তানকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের খ্যাতিমান চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। গত বছর বাংলাদেশের এ অবস্থান ছিল ১৩৯তম। আর এবার প্রতিবেশী দেশ ভারত ১৪৫তম, মিয়ানমার ১৪৩তম, নেপাল ১৪৯তম এবং পাকিস্তান ১৫৪তম অবস্থানে রয়েছে। এ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। তালিকায় প্রথম তিনটি দেশ হলো- আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস। এছাড়া যুক্তরাজ্য ২৩, যুক্তরাষ্ট্র ২৯, চীন ৪৮ ও রাশিয়া ৫৮তম অবস্থানে রয়েছে। তালিকায় সবার নিচে রয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকান।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে প্রাণঘাতী হবে না এমন ৩২টি রোগে মৃত্যু হারের ওপর ভিত্তি করে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। এসব রোগের তালিকায় রয়েছে যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, টিটেনাস, হাম, গর্ভপাত, শিশুরোগ, ত্বকের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, সার্ভিকাল ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, অণ্ডকোষে ক্যান্সার, হৃদরোগ, হার্নিয়া, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। জরিপে অর্থায়ন করেছে বিশ্বসেরা ধনী বিল গেটসের দাতা সংস্থা বিল অ্যান্ড মিলেন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। ল্যানসেট বাংলাদেশকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক থেকে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে রাখলেও বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
২০১৭ সালটি ছিল স্বাস্থ্য খাতে বেশ আলোচিত। বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার, জোড়া লাগানো দুই বোন তোহা আর তহুরার পৃথক হওয়া, লিভার সিরোসিস ও ফেইলিউরে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের অভাবনীয় উদ্ভাবনসহ চিকিৎসায় সাফল্য মানুষের মধ্যে অনেকটা আশার আলো ছড়িয়েছে। তাই সবকিছু ছাপিয়ে বছরব্যাপী সাফল্যের দিকগুলোই বেশি আলোচিত হয়েছে। পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক দূরীকরণসহ স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে বছরব্যাপীই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সরকারের প্রচারণার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবায় চরম নৈরাজ্য, চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মানসিকতা-স্বেচ্ছাচারিতা, রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, জিম্মি করাসহ নানা কারণে চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি আছে। স্বাবলম্বীরা পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেকেই এখন বিদেশমুখী। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য শুধু ভারতে গেছেন ১ লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি।
এত সব নেতিবাচক দৃষ্টান্তের ভিড়ে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের একাংশের পেশাগত আন্তরিকতা ও সাফল্য আশা জাগায় সাধারণ মানুষের মনে। তাই দেশের চিকিৎসকরা যদি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে চিকিৎসাসেবা এবং গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারেন, তাহলে রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমে যেত বলে মনে করছেন তারা। পাশাপাশি চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসত। গত বছরে স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম সাফল্যের নাম আবুল বাজানদার। পুরো বিশ্বেই এখন পরিচিত এই নামটি। ‘বৃক্ষমানব’ অভিহিত করে এই যুবকের বিরল রোগ নিয়ে সংবাদ প্রচার করে বিশ্বের তাবৎ গণমাধ্যম। তবে সেই বিরল রোগের প্রকোপ থেকে বাজানদার এখন অনেকটাই মুক্ত। এখনো চিকিৎসাধীন থাকলেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন। এ ক্ষেত্রেও কৃতিত্ব ঢাকা মেডিকেলের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের।
তোহা আর তহুরা- দুই বোন এখন একে অন্যের চেহারা দেখতে পায়। মায়ের কোলে বসে মিটিমিটি হাসে একজন আরেকজনকে দেখে। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় বিচ্ছন্ন করার পর সুস্থ জোড়া শিশু তোহা ও তহুরাকে।
২০০ বছর আগে ১৮১৭ সালে পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে এক মহামারী রোগের আবির্ভাব ঘটেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেইসময় সুন্দরবন এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক পাঠায়। যাদের দায়িত্ব ছিল বিস্তীর্ণ বনভূমি পরিষ্কার করে চাষাবাদ উপযোগী করা। কিন্তু কে জানত এই লোনা জলে ভাইবারিও কলেরা নামক ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল। এই ব্যাকটেরিয়া এসব ব্রিটিশ কর্মীদের শরীরের অন্ত্রে প্রবেশ করে ভেতর থেকে সবকিছু তরল করে বের করে দিতে শুরু করে। এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এসব ব্রিটিশ কর্মীদের শরীরে চরম পানিশূন্যতা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তাদের হার্টবিট দুর্বল হয়ে পড়ে, ইলেকট্রোলাইটের চরম ঘাটতি দেখা দেয় এবং ছয় ঘণ্টার মধ্যে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তখনকার চিকিৎসকরা এ রোগের কূলকিনারা করতে না পারলেও ২০০ বছর পরে বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি এ রোগের সফল ও গ্রহণযোগ্য টিকা আবিষ্কার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে যে চিকিৎসাব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে তা এতই কার্যকর যে, এটি এ রোগে আক্রান্ত মানুষের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশের জীবনরক্ষা করতে সক্ষম।
লিভার সিরোসিস অথবা অন্য কোনো কারণে লিভার অকার্যকর (ফেইলিউর) হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত- এমন ধারণা বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের দুই বিজ্ঞানী। সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এসব রোগের চিকিৎসায় অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন তারা। লিভার (যকৃত) ফেউলিউর রোগীদের নতুন পদ্ধতির এই চিকিৎসা শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)। তাকে সব ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছেন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। ইতোমধ্যে এই দুই চিকিৎসকের আবিষ্কার ন্যাসভ্যাক ওষুধ এবং স্টেমসেল চিকিৎসাপদ্ধতি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গবেষণা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক উন্নতি সাধন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। স্পেনভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ভারতীয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে অনেক ধাপ ওপরে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই শুরু হয়েছে দেশের প্রথম স্টেমসেল থেরাপির মাধ্যমে লিভার চিকিৎসাব্যবস্থা।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বিদেশ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসা রোগী যখন আমাদের চেষ্টায় স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, আবুল বাজানদার, তোহা ও তহুরা এবং মুক্তামণিকে নিয়ে চিকিৎসকদের সফলতার খবর জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সফলতা নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বইয়ে এদের ছবি এবং চিকিৎসা করা চিকিৎসকদের নিয়ে সাকসেস স্টোরি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, গত বছর ছিল আমাদের সাফল্যের বছর। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।