ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্মৃতিচারণ

বিচ্ছেদ ও ভালোবাসার প্রিয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ড. এ.টি.এম. সামছুজ্জোহা
🕐 ১:৪২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২০

গ্রাম থেকে যখন ঢাকা শহরে পা রাখি তখন এ শহরটি ছিল বড়ই আজব ও অচেনা এক জনপদ, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে ঘটে চলে নানা আজব আয়োজন। যা কখনও সময়কে করে আলোড়িত আবার কখনও আলোকিত। এই যাত্রাপথের শুরুতে অনেক জড়তা নিয়ে পথ চলা শুরু হলেও খুব সহজেই আমার প্রিয় বঙ্গবন্ধু হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্ত্বর, ক্লাসরুম, টিএসসি, বিএনসিসি-রোভার-বাঁধন-ডিবেটিং ক্লাবের মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আমাকে আপন করে নিয়েছিল স্বমহিমায়, যেখান থেকে আমি শিখেছি প্রতিনিয়ত, আপনমনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এ স্বপ্নবোনার পথে আমি একসময় আবিষ্কার করি আমার প্রথম ভালোবাসা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার স্বপ্ন। প্রথমবর্ষের প্রথম দিন থেকেই আমার মাঝে এ স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল (আমার এক চাচা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রথম শ্রেণিতে ২য় অবস্থানে ছিল, যা আমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করেছিল) যা পূর্বে সকল উল্লেখিত সংগঠনের শিক্ষার সাথে সংযুক্ত হলে নিজ মনে ক্লাসরুমের ডায়াসে দাঁড়িয়ে প্রিয় শিক্ষকগণের মতো করে কিছু বলার সুযোগের স্বপ্ন বুনতে থাকি। একেকটি দিন সমাপণের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বপ্ন আরও শাণিতো হতে থাকতো। এভাবে কৃতিত্ত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবণের সমাপ্তি হলেও আমার ভালবাসার কোন ঘাটতি কখনও হয়নি। এজন্য আমার বন্ধুরা যখন অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল তখন আমি শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

এ কারণে যখন প্রথম চাকরি হিসেবে শহিদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি যা ছিল আমার ভালোবাসার জীবনের প্রথম ধাপ এবং মাত্র ৪ মাসের শিক্ষকতার এ সময়টি তাই আজো আমাকে আলোড়িত করে। ২০০৮ সালে এ কলেজে শিক্ষকতার সময়কালে যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম লেকচারার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই সে দিনটি ছিল এক অনন্য দিন, আমার প্রথম ভালোবাসার পূর্ণতা প্রাপ্তির প্রথম ধাপ। ২০০৮ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সত্যিকার অর্থেই শিক্ষকতার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগলাভ হয়েছিল বলে সে ভালোবাসা আজো অমলিন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগদানের পর দেখলাম বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যাঁরা কর্মরত আছেন সকলেই আমার মুরুব্বি অর্থাৎ আমি ছিলাম বয়সে সবার ছোট এমনকি কারো কারো সন্তানতুল্য।

বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাহানারা বেগম (আপা গত হয়েছেন কয়েক বছর হয়ে গেছে, আল্লাহপাক আপাকে বেহেশতবাসী করুন) প্রথম যোগদানের দিন আমাকে অন্য সব সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, এই ছেলেটিকে আমি প্রথম দেখেছি ভাইভা বোর্ডে এর আগে কখনও দেখিনি (উল্লেখ্য, ভাইভার পূর্বে বোর্ডের সদস্যগণের সঙ্গে দেখা না করলে চাকরি প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। কিন্তু আমি সত্যিকার অর্থেই জানতাম না যে ভাইভা বোর্ডে কে আছেন এবং কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে)।

সম্ভবত এ কারণে আমার প্রতি চেয়ারম্যান আপার এক অপার ভালোবাসা কাজ করেছিল এবং একই সঙ্গে আমি তাঁর মাঝে দেখেছি আমার প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ এবং একান্তই তা সহকর্মী হিসেবে। বিভাগে যোগদানের পর আমি প্রতিনিয়ত ভালোবাসায় সিক্ত হতে থাকি আসরারুল হক চিশতী স্যার, ইমতিয়াজ স্যার, আসাদ স্যার, আউয়াল স্যার, নুরুল ইসলাম স্যার, হাবিব স্যার, বড় আফরোজা এবং ছোট আফরোজা আপা, সদা হাস্যময়ী রওশন আরা আপা, হাফিজা আপা, আয়শা আপা, মমতাময়ী সাজেদা ইউসুফ আপা প্রমুখ প্রিয় সহকর্মীর। আমার মাত্র ১০ মাসের এই কর্মজীবনে প্রতিক্ষণে আমি শিখেছি তাঁদের ভালোবাসায়- আদরে যা আজও অমলিন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভালোবাসার বড় যে ক্ষেত্রটি আমাকে আজও স্মৃতিকাতর করে তোলে সেটি হলো শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে আমার বিপুল সংখ্যক স্নেহের শিক্ষার্থীর সংস্পর্শে আসার মধুময় দিনগুলো। মাত্র ৪ মাসের শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন আমি জগন্নাথে যোগদান করি তখন সেখানে সাবেক জগন্নাথ কলেজ থেকে আত্মীকৃত শিক্ষার্থীদের কয়েকটি ব্যাচ অধ্যয়নরত যাদের অনেকেই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এই দুটি সত্ত্বাকে ধরে রাখা এবং ছেড়ে দেওয়া এই প্রক্রিয়ার যাতাকলে পিষ্ট। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও অনেকেই মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারছেন না।

এমতাবস্থায় তাদের মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি জাগরুক করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ (যদিও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান ছিল)। যা হোক খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি তাদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলাম এবং শিক্ষার্থীরাও আমাকে আপন করে নিয়েছিল (যদিও আমাকে প্রথম দেখে তাদের অনেকেরই হয়তো আমাকে নিয়ে সন্দেহ ছিল যে আমি তাদের কাছাকাছি যেতে পারবো কি-না)। শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীদের অনন্য ভালোবাসায় সিক্ত আমি যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১০ মাসের শিক্ষকতার শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছিলাম তাইতো তখন ওখানে যোগদান করব কি-না তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম যা আরও জোরদার হয়েছিল আমার শিক্ষার্থীদের জগন্নাথ থেকে যাওয়ার আহবানে। তাদের সেই আহবানে আমার সাড়া দেয়ার সুযোগ হয়নি আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসার কারণে কিন্তু আজও আমি আমার স্বল্পকালীন সময়ের ঐ ভালোবাসার মানুষগুলোকে স্মরণ করি আপন আবেশে। আজও তাদের অনেকের সাথে যোগাযোগ হয়, হয় ভালোবাসার বিনিময় যা কোন পার্থিব সুখ দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না।


ড. এ.টি.এম. সামছুজ্জোহা
সহযোগী অধ্যাপক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper