ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কাঁদছে রুপালি গিটার...

বাংলার কিংবদন্তি রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:১০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০১৮

‘এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে/সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো/গোপন করে।/মনে রেখো তুমি/কত রাত কত দিন/শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন/অধরে তোমার ফোটাতে হাসি/চলে গেছি শুধু/ সুর থেকে কত সুরে...’।

বাংলা ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি, এই উপমহাদেশের অন্যতম রকতারকা আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তার অকালপ্রয়াণ ঘটেছে। (ইন্না...রাজিউন)। সত্যিকার অর্থেই তিনি তার রুপালি গিটার ফেলে চলে গেছেন বহুদূরে। না ফেরার দেশে। তার প্রয়াণে কাঁদছে তারুণ্য, কাঁদছে দেশ। কাঁদছে তার রুপালি গিটারও। মানুষের অধরে হাসি ফোটাতে ক্লান্তিহীন তিনি গেয়ে গেছেন টানা চার দশক। ভ্রমণ করেছেন সুর থেকে সুরে। তার প্রয়াণে অশ্রু গোপন থাকেনি কারও।

গতকাল সকালে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকার মগবাজারের নিজ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।

স্কয়ার হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. মো. নাজিম উদ্দিন জানান, অসুস্থ অবস্থায় আইয়ুব বাচ্চুকে তার গাড়িচালক সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকদের একটি বিশেষজ্ঞ দল দেখাশোনার পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডা. নাজিম বলেন, আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘদিন ধরে হৃদযন্ত্রের অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত সপ্তাহেও স্কয়ার হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। তার হার্টের কার্যক্ষমতা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।

আইয়ুব বাচ্চুর খ্যাতনামা ব্যান্ডদল এলআরবির ড্রামার রুমেল ও শামীম জানিয়েছেন, গতকাল সকালে নিজের বাসায় আইয়ুব বাচ্চু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অচেতন অবস্থায় তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল এবং শ্বাস বন্ধ ছিল। ডাক্তাররা দ্রুত তার নিঃশ্বাস ফেরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে ডাক্তাররা জানিয়েছেন হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতেই তার মৃত্যু হয়েছে।

ব্যান্ড দল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং প্লে-ব্যাক শিল্পী। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত যে কজন মানুষের হাত ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আইয়ুব বাচ্চু তাদের মধ্যে প্রধানতম। তিনি ছিলেন বাংলার তুমুল জনপ্রিয় রকতারকা। টানা চার দশক ধরে নিজের সঙ্গীত ও সুর-মুর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছেন তরুণদের। তার অনবদ্য ও অভাবিত গিটার বাদন তাকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। টানা তিন দশকে হৃদয় ও রক্তস্পর্শী তার কথা ও সুরের উন্মাদনায় ভেসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এখনো ভাসছে, আরো বহুকাল ভাসবে বলেই মনে করেন সংগীতানুরাগীরা। তিনি তার গিটারে কেবল রক বা ব্যান্ডের সুরই তুলেননি, তুলেছেন আধুনিক ও লোক সুরও। মুক্তমঞ্চ পরিবেশনায় আইয়ুব বাচ্চুর জুড়ি এখনো খুঁজে পান না সংগীতবোদ্ধারা। এখনো আইয়ুব বাচ্চুর সুর ও গায়কীর শরণ নেয় তরুণ প্রজন্ম। কারণ তারুণ্যের উন্মাদনা, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন-সম্ভাবনা সবকিছুকে নিয়েই আইয়ুব বাচ্চু লিখতেন আর গাইতেন।

‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ‘ফেরারি এই মনটা আমার,’ ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘বাংলাদেশ’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিসনে’-এরকম বহু জনপ্রিয় গান আরও বহুকাল টিকে থাকবে স্রোতাদের হৃদয়ে। টিকে থাকবে প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর নামও।

সকালে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনই নয়, কোটি ভক্ত-স্রোতার মাঝে নেমে আসে শোকের স্তব্ধতা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বজন, সহকর্মী, সংগীতশিল্পী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে স্কয়ার হাসপাতালে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেরও অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন এ কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যুতে।
আইয়ুব বাচ্চু জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে। সেখানেই কেটেছে কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো। তার বয়ান থেকেই জানা যায়, পশ্চিমা সংগীতের প্রেমে পড়ে একদিন হাতে তুলে নেন গিটারে। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুরের মতো শিল্পীরা তার অনুপ্রেরণা। ১৯৭৮ সালে ব্যান্ডদল ফিলিংসে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু হয়। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে গান গাইতেন তিনি। তার দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে। ১০ বছর ছিলেন সোলসের লিড গিটারিস্ট। পরে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল জয়, স্বপন ও এসআই টুটুলকে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড দল ‘এলআরবি’। প্রথমে এলআরবির পূর্ণ রূপ ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে তা বদলে করা হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। ইংরেজি গান দিয়ে এলআরবির পথচলা শুরু হলেও পরবর্র্তীতে বাংলা গানেই জনপ্রিয়তা পায় এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চু। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এলআরবি ও আইয়ুব বাচ্চু সমার্থক ছিল। ১৯৯২ সালে দলের নামেই বাজারে আসে এলআরবির জোড়া অ্যালবাম ‘এলআরবি-১ ও ২’। এরপর গত ২৭ বছরে আসে ১৪টি অ্যালবাম; যার প্রতিটি গানই উন্মাদনায় ভাসিয়েছে শ্রোতাদের। সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারী মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮) এবং যুদ্ধ (২০১২) ছিল এলআরবি ব্যান্ডের অ্যালবাম। অ্যালবামগুলোতে আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া এমন কোনো গান পাওয়া যাবে না যেটা ‘অজনপ্রিয়’ তকমা পাবে। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম বের হয় ১৯৮৬ সালে-‘রক্ত গোলাপ’। কিন্তু সেটা তেমন একটা স্রোতাপ্রিয়তা পায়নি। তবে ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে বাচ্চু জনপ্রিয় হতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বাচ্চুর তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। পরবর্তীতে ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সন্ট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯) ও জীবনের গল্প (২০১৫) অ্যালবামগুলো ব্যাপক স্রোতাপ্রিয়তা পায়।

আইয়ুব বাচ্চু ‘লাল বাদশা’, ‘গুণ্ডা নাম্বার ওয়ান’, ‘ব্যাচেলর’ ও ‘চোরাবালি’ সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেছেন। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান-‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, চার দশকের সংগীত জীবন নিয়ে একটি আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা ছিল তার। বহুদূর যেতে চেয়েছিলেন তিনি। হাঁটতে চেয়েছিলেন আর অনেকটা পথ। কিন্তু তার আর হাঁটা হলো না।

সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু গতকাল জানিয়েছেন, আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। জুমার নামাজের পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে হবে তার প্রথম জানাজা।

কিংবদন্তি এ রকস্টারের জীবনাবসানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমেছে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরাও জানিয়েছেন শোক। বাংলা গানের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী কবীর সুমন তার ফেসবুকে পেজে লিখেছেন ‘আইয়ুব বাচ্চু আর নেই? যাওয়ার কথা তো আমার। ও গেল। দুঃশশালা। ভালো শিল্পী, কী ভালো মানুষ! ধুৎ।’ শিল্পী অঞ্জন দত্ত লিখেছেন, ‘টেরিবল লস... আইয়ুব বাচ্চু...’। আরেক জনপ্রিয় গায়ক, গীতিকার ও সুরকার অনুপম রায় লিখেছেন, ‘বাচ্চু ভাইয়ের এভাবে হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া কঠিন। বাংলা গান চিরদিন মনে রাখবে এই চমৎকার গুণী মানুষটিকে।’

বাংলাদেশের চিরকুট ব্যান্ড তাদের ফ্যান পেজে লিখেছে, আসমাদের গানের পাখি, বাংলা ব্যান্ডের কিংবদন্তি আমাদের আইয়ুব বাচ্চু ভাই, এলআরবির আইয়ুব বাচ্চু ভাই, বাংলাদেশের আইয়ুব বাচ্চু ভাই আমাদের সবার মাথার ছায়া এবি আর নেই!।

এদিকে প্রিয় শিল্পীর আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে টাইগারদেরও। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিল তাদের অনুশীলন। সকালে যখন জিম্বাবুয়ে সিরিজের অনুশীলনে ব্যস্ত ছিল টিম টাইগার, ঠিক তখনই আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সংবাদ তারা পায়। প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে টিম বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিজেন্ডের সেই গানটি লিখেছেন- ‘সবাইকে একা করে চলে যাব অন্ধ ঘরে, এই শহরে গাড়ি-বাড়ি কিছুই রবে না’। শোক জানিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন মুশফিকুর রহিম। আইয়ুব বাচ্চুর একজন বড়মাপের ভক্ত জানিয়ে ফাস্টবলার রুবেল হোসেন বাচ্চুর সঙ্গে তার একটি ছবি পোস্ট দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সত্যি মানতে পারছি না আমি ছোটবেলা থেকেই জেমস ভাই, বাচ্চু ভাই- এদের গান শুনি। আমি বাচ্চু ভাইয়ের বিশাল বড় একজন ফ্যান, সেদিনও টিভিতে তার কনসার্ট দেখছিলাম- আল্লাহ এটি কি হয়ে গেল!’

 
Electronic Paper