কিংবদন্তি অভিনেতার চিরবিদায়: ইউসুফ থেকে যেভাবে দিলীপ কুমার
ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৮, ২০২১
বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপ কুমার (৯৮) মারা গেছেন। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্ষীয়ান এই অভিনেতার মৃত্যুতে ভারতের চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অভিনেতা দিলীপ কুমারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন দিলীপ কুমার। গত কয়েক দিন ধরেই তিনি মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। সেখানেই সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দুদিন আগেই তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়ে টুইট করেছিলেন স্ত্রী সায়রা বানু। তিনি লিখেছিলেন, ‘দিলীপ কুমার সাহেবের শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। তবে তিনি এখনো আইসিইউতেই আছেন। আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই। তবে চিকিৎসক এখনো অনুমতি দেননি। আপনারা তার জন্য প্রার্থনা করুন।’
দিলীপ কুমার বলিউডে ‘ট্র্যাজেডি কিং’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ৬৫টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দেবদাস’, ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘ক্রান্তি’, ‘কর্মা’ ইত্যাদি। তাকে শেষ পর্দায় দেখা গিয়েছিল ১৯৯৮ সালে ‘কিলা’ ছবিতে।
ইউসুফ থেকে দিলীপ কুমার: হিন্দি সিনেমার জগতে এই অভিনেতা দিলীপ কুমার নামে পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান। তাহলে কীভাবে তিনি দিলীপ কুমার হলেন। ধর্ম পাল্টে? একেবারেই নয়। তিনি মুসলমান ধর্মের অনুসারী। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পেশোয়ারে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিল দিলীপ কুমারের। তখন তার নাম রাখা হয় মুহাম্মদ ইউসুফ খান। অভিনেতার বাবা লালা গোলাম সারওয়ার একজন ফলের ব্যবসায়ী ছিলেন যিনি পেশোয়ার ও দেওলালীর মধ্যে ফলের বাগানের মালিক ছিলেন। তার মায়ের নাম আয়েশা বেগম। তিনি নাসিকের (মহারাষ্ট্র) কাছাকাছি মর্যাদাপূর্ণ দেওলিয়ার বার্নস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন।
১৯৩০ সালের শেষ সময়ে ১২ সদস্যের পরিবার নিয়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান দিলীপ কুমার। ১৯৪০ সালে অভিনেতা তাদের পুনের বাড়ি ছাড়েন, যেখানে তিনি একজন ক্যান্টিন মালিক এবং একজন শুষ্ক ফল সরবরাহকারী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে ‘বম্বে টকিজ’-এর মালিকানাধীন অভিনেত্রী দেবিকা রানী ও তার স্বামী হিমাংশু রাই পুনের অন্ধ সামরিক ক্যান্টিনে দিলীপ কুমারকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। পরের বছর ১৯৪৪ সালে ‘জোয়ার ভাটা’ চলচ্চিত্রটির জন্য দিলীপকে প্রধান চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন দেবিকা রানী ও হিমাংশু রাই। এই চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউড শিল্পে প্রবেশ করেন দিলীপ কুমার। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান হলেও হিন্দি লেখক ভগবতি চরণ বর্মা পরবর্তীতে তার পর্দার নাম দেন দিলীপ কুমার। সেই থেকে তিনি এই নামেই ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পরিচিত।
১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন দিলীপ কুমার। তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ইউসুফ খান। রুপালি পর্দায় ক্যারিয়ার শুরুর সময় নাম পাল্টান তিনি। ছয় দশকের অভিনয় জীবনে ‘মধুমতি’, ‘দেবদাস’, ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘গঙ্গা যমুনা’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘কর্ম’র মতো অসংখ্য ধ্রুপদী সিনেমায় দেখা যায় তাকে। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাব অর্জন করেন দিলীপ কুমার। ১৯৯১ সালে তাকে দেওয়া হয় ‘পদ্মভূষণ’। এর তিন বছর পর দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ডও পান তিনি।
এক ফোনেই শান্তি প্রতিষ্ঠা
কারগিল সীমান্তে ১৯৯৯ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখি, তখন চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তে এক ফোনেই দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের ক্রান্তিকালে চমৎকার ওই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন কিংবদন্তি বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমার, যার আসল নাম ইউসুফ সারোয়ার খান। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কোরেশী তার আত্মজীবনীতে এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তার এক সহকারী জানালেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ফোন করেছেন এবং দ্রুত তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন।
নওয়াজ শরিফ ফোন ধরা মাত্রই বাজপেয়ী বলছেন, এটা কী হচ্ছে? আপনি যখন লাহোরে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন তখন পাকিস্তানি সেনারা কারগিলে আমাদের ভূখণ্ড দখল করেছে। খুরশিদ মেহমুদ কোরেশী তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, ওই ফোনালাপ শেষ হওয়ার আগে বাজপেয়ী নওয়াজ শরিফকে বলেন, আমি চাই আমার পাশে বসা একজনের সঙ্গে আপনি কথা বলুন, যিনি আমাদের আলোচনা শুনেছেন। আর এটা এমন একজনের সঙ্গে ছিল যার কণ্ঠ শুধু নওয়াজ শরিফের কাছেই নয় বরং পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই সুপরিচিত ছিল। এটা ছিল দিলীপ কুমারের কণ্ঠ, যা কয়েক দশক ধরে সিনেমাপ্রিয় ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের হৃদয় শাসন করেছে।
দিলীপ কুমার নওয়াজ শরিফকে বলেছিলেন, মিঞা সাহেব এটা আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। আপনি সম্ভবত জানেন না যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন উত্তেজনা দেখা দেয় তখন ভারতে মুসলিমদের অবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কখনো ঘরের বাইরে যাওয়াটাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। দয়া করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু একটা করুন। আর এভাবেই তিনি একটি সংঘাত থেকে দুটি দেশকে নিবৃত করেছেন। শুধু চলচ্চিত্র নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেও যুক্ত ছিলেন কিংবদন্তি এ বলিউড অভিনেতা।
অটোগ্রাফ পেতে ৪৬ বছর লেগেছিল অমিতাভের: দিলীপ কুমারের মৃত্যুর আগে তাকে নিয়ে একবার স্মৃতিচারণা করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তিনি জানান, দিলীপ কুমারের অটোগ্রাফ পেতে তার ৪৬ বছর লেগেছিল। প্রথমবার মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন দক্ষিণ মুম্বাইয়ের একটি হোটেলে, যেখানে দিলীপ কুমার উপস্থিত ছিলেন। নায়ককে ঘিরে ভিড়ের কারণে তিনি সফল হননি সেদিন। অমিতাভ জানান, কিছুকাল পর আরেকটি সুযোগ আসে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একটা পার্টি দিয়েছিলেন। দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, রাজ কাপুর হাজির। কিন্তু সেই পার্টিতেও অমিতাভ প্রিয় তারকার অটোগ্রাফ নিতে পারেননি।
এমনকি ১৯৮২ সালে ‘শক্তি’ ছবিতে দিলীপ কুমারের সঙ্গে কাজ করলেও অমিতাভ তার অটোগ্রাফ সংগ্রহে ব্যর্থ হন। অবশেষে তার স্বপ্ন সত্যি হয় ২০০৫ সালে। রানি মুখার্জির সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’ সিনেমায় ছিলেন অমিতাভ। রানির আমন্ত্রণে স্ত্রী সায়রা বানুকে নিয়ে ছবি দেখতে এসেছিলেন দিলীপ কুমার। ছবি দেখে আপ্লুত দিলীপ কুমার অমিতাভকে একটা দীর্ঘ চিঠি লেখেন। তাতে অনেক প্রশংসাবাক্য থাকলেও চিঠির শেষে দিলীপ কুমারের সই দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান অমিতাভ বচ্চন। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পায় দিলীপ কুমারের প্রথম ছবি ‘জোয়ার ভাটা’। প্রথম দিকে দিলীপ কুমারের কয়েকটি ছবি ব্যবসাসফল ছিল না।
১৯৬০ সালে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা ‘মুঘল-এ-আজম’ দিলীপ কুমারের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনি ৬৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার স্ত্রী মুম্বাই চলচ্চিত্রের আরেক অভিনেত্রী সায়রা বানু।