মিলছে না অনেক হিসাব
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২১
অভিনেত্রী পরীমনিকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে অভিযোগের সঙ্গে অনেক কিছুরই মিল পাচ্ছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ঢাকার আরেকটি ক্লাবে গিয়ে হাঙ্গামা বাধানোর অভিযোগ ওঠায় পরীমনির বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
গত বুধবার গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবের সভাপতি কে এম আলমগীর ইকবাল অভিযোগ করেন, গত ৭ জুন মধ্যরাতে পরীমনি ও তার সঙ্গীরা গুলশানে তার ক্লাবে গিয়ে ‘হাঙ্গামা’ বাধিয়েছিলেন। এ সময় পরী ক্লাবের গ্লাস-প্লেট ভাঙচুর করেন। যদিও রাতেই সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন পরীমনি। তিনি বলেন, মূল ঘটনা থেকে নজর সরাতে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানিয়েছেন, গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবে পরীমনির ভাঙচুর চালানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে অবশ্যই এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে ক্লাবের সভাপতি জানিয়েছেন, পরীমনির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। গ্লাস-প্লেট ভাঙচুর করা কোনো বড় ঘটনা নয়। যেসব হিসাব মিলছে না
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সাভার থানায় যে মামলা হয়েছে, সেই মামলার এজাহারের বর্ণনার সঙ্গে অনেক কিছুরই অমিল পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে ঘটনাস্থল ঢাকা বোট ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আসামি অমির কালো গাড়িটি বোট ক্লাবের সামনে এসে থামার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের ভেতরে প্রবেশ করেন পরী ও তার সঙ্গীরা। তবে মামলার এজাহারে এই নায়িকা উল্লেখ করেছেন, সেই রাতে অমি পরিকল্পিতভাবে পরী ও তার সঙ্গীদের বোট ক্লাবে নিয়ে যায়। অমি জানায় সেখানে তার দুই মিনিটের কাজ আছে। পরী, তার ছোট বোন ও কস্টিউম ডিজাইনার জিমি গাড়িতে অপেক্ষা করেন। একপর্যায়ে ছোটবোন টয়লেট ব্যবহার করবে জানালে তারা ক্লাবের বারের পাশের একটি টয়লেটের দিকে যান।
ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কালো রঙের একটি গাড়িতে ওই রাত ১২টা ২২ মিনিটে পরীমনি ক্লাবে ঢোকেন। তখন তাকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটেই ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। কিন্তু এক ঘণ্টা ৩৭ মিনিট পর তাদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তখন দেখা যায় পরীমনির হাত ও পা ধরে দুজন ধরাধরি করে তাকে সাদা রঙের একটি গাড়িতে তুলছেন।
তবে বোট ক্লাবের যে বারে পরীমনির অভিযোগ অনুসারে ধর্ষণচেষ্টা ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা নেই। তাই পুলিশের হাতে থাকা ভিডিও ফুটেজে ওই রাতে আসলে কী ঘটেছিল সেই চিত্র নেই। তবে ওই বারে পরীমনির সঙ্গে থাকা তার কস্টিউম ডিজাইনার জিমি মোবাইল ফোনে ১৫ সেকেন্ডের ধস্তাধস্তির একটি ভিডিও করেছিলেন। এতে ভরাট পুরুষ কণ্ঠে গালমন্দ ও হই-হুল্লোর শোনার কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন নাসির ও অমি
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ এবং তুহিন সিদ্দিকী অমি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য দিয়েছেন। অমি জানিয়েছেন, সে রাতে পরী ও তার সঙ্গীদের নিয়ে তিনি ক্লাবের ভেতরে গিয়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ একসঙ্গে মদ পান করেন। শেষে একটি বোতল নেওয়া নিয়ে প্রথমে একজন কর্মচারীর সঙ্গে পরীমনি বিত-া করেন। সেই বিত-ায় যোগ দেন নাসিরসহ আরও কয়েকজন।
অমি জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছেন, বোট ক্লাবে যাওয়ার আগে পরীমনির বনানীর বাসায় বসেই তারা সবাই এক বোতল মদ পান করেন। এ সময় বাসায় নাট্যপরিচালক চয়নিকা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে অমি স্বীকার করেছেন যে, মদ্যপ অবস্থায় পরীমনিকে নাসির কয়েকটি থাপ্পড় দেন। এ সময় মেঝেতে পড়ে যান পরীমনি। পরে ধরাধরি করে পরীকে গাড়িতে তোলা হয়। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনিকে থাপ্পড় দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন নাসির উদ্দিন মাহমুদ।
এজাহারে নায়িকা পরীমনি উল্লেখ করেছেন, অমিসহ ১ নম্বর আসামি (নাসির) তাকে মদ্যপান করার জন্য জোর করেন। মদ্যপান করতে না চাইলে ১ নম্বর আসামি জোর করে মুখের মধ্যে মদের বোতল ঢুকিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে তিনি সামনের দাঁত ও ঠোঁটে আঘাত পান। এ সময় ১ নম্বর আসামি তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করে এবং জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
সেই নাসির গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাবেরও সদস্য
নায়িকা পরীমনিকে বোট ক্লাবে ধর্ষণচেষ্টার মামলায় গ্রেফতার উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদ গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবেরও সদস্য। গত বুধবার অভিযোগ পাওয়া যায়, বোট ক্লাবের ঘটনার ঠিক আগের রাতে গুলশানের এই ক্লাবটিতে গিয়ে হাঙ্গামা করেন পরীমনি ও তার বন্ধুরা।
এ বিষয়ে ক্লাবটির সভাপতি কে এম আলমগীর ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই জানা যায়, নাসির উদ্দিন মাহমুদ এই ক্লাবটিরও সদস্য। আলমগীর ইকবাল বলেন, ‘নাসির উদ্দিন মাহমুদ উত্তরা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমাদের ক্লাবেরও উনি সদস্য, কিন্তু উনি কখনো আসেন না। এখনও সদস্যপদে আছেন।’ সেই রাতে কি ঘটেছিল জানতে চাইলে আলমগীর ইকবাল বলেন, ‘৭ জুন ক্লাবে ছোট্ট একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছিল। ক্লাব বন্ধের সময় হয়ে এসেছিল। তখন কয়েকজন লোক এসেছিল ক্লাবে প্রবেশের জন্য। গেটে দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ডরা ফোন করে জানায়, তারা কিছুক্ষণ আগে একবার এসেছিলেন। তখন তারা ফোন ও কিছু কাগজ রেখে গেছেন। সেগুলো নেওয়ার জন্য তারা আবার এসেছেন। তো আমাদের ক্লাবের নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন আছে। ক্লাবে প্রবেশের ড্রেস কোড রয়েছে। সেদিন এখানে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হাফপ্যান্ট এবং স্যান্ডেল পরা। তখন আমাদের ফুড অ্যাডভাইজার দেখে বলেন, আপনারা তো ক্লাবের নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। তাদের ক্লাব থেকে এটা বলায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, এই সময়ে তারা যে সদস্যের মাধ্যমে ক্লাবে আসেন তিনিও তাদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু তারা যেতে চাননি। পরে বাধ্য হয়ে আমাদের সেই সদস্য চলে যান। এর মধ্যে আমাদের ক্লাবের সব কর্মকর্তা চলে যান। শুধু দুজন ওয়েটার ছিলেন। এরই মধ্যে তারা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কল করে পুলিশ ডাকেন। পুলিশ এলে তারা ক্লাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাদের হেনস্তার অভিযোগ করেন। কিন্তু বাস্তবে তখন আমাদের তেমন কেউ ছিল না। ঘটনার সময় তখন রাত ১টা থেকে দেড়টা বাজে। ওই সময় তাদের একজন ক্লাবের ১৫টি গ্লাস, নয়টি এসট্রে, বেশ কিছু হাফ প্লেট ভাঙচুর করেন। পরে আমরা জানতে পারি, তিনি পরীমনি। পুলিশ এসেও এর সত্যতা পায়। পরে পুলিশ ঘটনার বিষয়ে তাদের ঊর্ধ্বতনদের জানায়। তারা ওই পুলিশ সদস্যদের চলে যেতে বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আলমগীর ইকবাল বলেন, পরীমনির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমাদের নেই। এমন কিছু তো করেননি। কয়েকটা গ্লাস-প্লেট ভেঙেছেন, সেটা যেই মেম্বারের অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন সেই মেম্বারই দিতে পারতেন। ক্লাবের মেম্বারের সঙ্গে যারা ক্লাবে আসেন তারা শুধু মেম্বারেরই নন, ক্লাবেরও অতিথি। ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী যে সদস্যের মাধ্যমে তারা এসেছিলেন, আমরা তাকে শোকজ করেছি। তার বিরুদ্ধে ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি চলমান রয়েছে।
গত ৭ জুন মধ্যরাতে গুলশানের অল কমিউনিটি ক্লাবে যাওয়ার কথা পরীমনিও স্বীকার করেছেন। সিসি টিভির ফুটেজে পরীমনির সঙ্গে তার সাবেক বাগদত্তা সাংবাদিক তামিম হাসান, কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ করিম জিমি ও আরেক নারীকে সে রাতে ক্লাবে ঢুকতে দেখা যায়। তবে হাঙ্গামার অভিযোগ অস্বীকার করে পরীমনি সাংবাদিকদের সামনে প্রশ্ন রেখেছেন- সেদিন ক্লাবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকলে তা আটদিন পর কেন প্রকাশ করা হলো? তিনি দাবি করেন, মূল ঘটনা থেকে নজর সরাতে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।
ক্লাবে ভাঙচুরের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা : ডিবি
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আমরা উত্তরার ডিসির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। পরে এ বিষয়ে জানানো হবে।’