যে সংবাদে লজ্জিত হই
রনি রেজা
🕐 ৯:২১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২০
সংগত কারণেই ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের সংবাদ এড়িয়ে যান অনেকেই, আমিও তাদের একজন। হোক খবর পড়ার সময় বা প্রকাশের সময়। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, পড়তে ভালো লাগে না। কষ্ট, ক্ষোভ, লজ্জা চেপে ধরে। নিজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। এর রোধে কিছুই করতে পারছি না।
কোনো প্রতিকার পদক্ষেপ নিতে পারিনি। না আমি, না রাষ্ট্র। এ কষ্ট কুরে কুরে খায়। এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। থাকে অসহায়ত্বও। প্রতিটি খবর পাঠের সময় মনে হয় নির্যাতিত ব্যক্তি আমাকে ধিক্কার দিচ্ছে। গালি দিচ্ছে। সব শেষে আমার অসহায়ত্বের প্রতি করুণার হাসি নিক্ষেপ করছে। পরের কারণটি পূর্ব অভিজ্ঞতার ফল।
ইতিপূর্বে দেখেছি খবর প্রকাশ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ বা তৎপরতা থাকলেও পরে তা বিলীন হয়ে যায়। হারিয়ে যায় পরের ঘটনার গর্ভে। উদাহরণ অসংখ্য। তনু, খাদিজার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আবার কিছু বিচার-প্রক্রিয়া আশা জাগায়। কিছুদিন আগেই নুসরাত হত্যার রায় হয়েছে।
আশা করছি কার্যকরও হবে দ্রুত। ফলে আশার প্রদীপে তেলের সঞ্চার ঘটেছে। এখনো যেগুলোর বিচার হয়নি; হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এরপরও কেন বেড়ে চলছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন? বৃহস্পতিবার আনিসুর সুমন নামে এক সাংবাদিক বন্ধু ধর্ষণ বিষয়ক কয়েকটি শিরোনাম ফেসবুকে তুলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘খবরগুলো গত ২৪ ঘণ্টার, মাত্র দুটো পত্রিকার অনলাইন থেকে নিয়েছি। হেডলাইনজুড়ে কেবল ধর্ষণ। কোথাও হত্যা।’
তার স্ট্যাটাসে যে শিরোনামগুলো স্থান পেয়েছে তার কয়েকটি দেয়া হলো- ‘বাসাভাড়া দিতে না পারায় স্বামীকে আটকে নারীকে গণধর্ষণ, ঘটনা ঢাকার আশুলিয়ায়।’, ‘ভোলার চরফ্যাশনে স্বামীকে খুঁজতে এসে গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূ।’, ‘মৌলভীবাজারে বেড়াতে নিয়ে কলেজছাত্রীসহ দুই তরুণী ধর্ষণের শিকার।’, ‘সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায় দাদার বিরুদ্ধে নাতনিকে ধর্ষণের অভিযোগ। ‘দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে শিশুকে কৌশলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ’, ‘রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ঋণ শোধে ধর্ষকের হাতে কিশোরী মেয়েকে তুলে দিল বাবা।’, ‘ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে ধর্ষণ মামলায় পুলিশ সদস্য গ্রেফতার।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ। ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৫৮ নারী। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭০ জন। ২০১৯ যৌন হয়রানির শিকার ১৮ নারী আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।
যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত বছর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬৭ নারী। তাদের মধ্যে নির্যাতনে নিহত হন ৯৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন তিনজন। আর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৪২৩ নারী। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- নারী নির্যাতনের সংবাদের সব তো আর খবরের কাগজে আসে না। এই হিসাবই বলে দেয় নারী নির্যাতনে নানা ধরনের আইন করা হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণে কমছে না নারী নির্যাতন।
এ পরিসংখ্যানগুলো আমাদের বড় বড় অর্জনকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় লজ্জিত হওয়ার ক্ষমতাটুকুও নিজেরা হারিয়ে ফেলেছি। প্রতিদিনই নির্যাতন, ধর্ষণের খবর আর পাঁচটি সাধারণ ঘটনার মতোই পড়ে যাচ্ছি। একটু শিহরণ জাগছে না। বরং অনেকে ঘটনাকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালায়। ধর্ষিত বা নির্যাতিতার ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিটি ঘটনা শেষেই এমন বিতর্ক আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই এমন সব বিতর্কে অংশ নেয়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায়ও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী কয়েক দিন আগে রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পরপরই তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষণকারীকে গ্রেফতারও করা হলো। তবু পিছু ছাড়লো না বিতর্ক। গ্রেফতার ধর্ষককে নির্দোষ প্রমাণেও সোচ্চার হলো একটি গোষ্ঠী। দিতে থাকল যুক্তি, অপব্যাখ্যা। বুদ্ধিজীবী নামধারী অনেকেও সেই দলে যুক্ত হলেন।
যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় তারা প্রত্যেকেই দেখেছেন নিশ্চয়ই। উদাহরণের প্রয়োজন নেই বলে মনে করছি। এসব সমালোচনা ধর্ষককে আরও উসকে দিচ্ছে। আড়ষ্ট করে দিচ্ছে নারীকে। বাধাগ্রস্ত করছে নারীর এগিয়ে যাওয়াকে। আজ যে সময়ে সমাজের সব ক্ষেত্রে নারী তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ভালো ফল অর্জন, প্রশাসনের চ্যালেঞ্জিং সেক্টরে অংশগ্রহণ, দায়িত্বশীল কর্মক্ষেত্রে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদসহ বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে, গার্মেন্টস, কৃষিকাজ, শিল্পকারখানায় চাকরি এমনকি বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে।
এমন সময়ে রাষ্ট্র, সমাজের উচিত পাশে থেকে এগিয়ে নেওয়া। সমাজ কি সেটা পারছে? নিরাপত্তাহীনতার ভিতর কোনো দুর্ঘটনার শিকার নারীকে পাশে থেকে সাহস না জুগিয়ে আমরা তাকে দোষী করতে নানা কসরত করি। আজ ক্রমাগত ধর্ষণ বৃদ্ধি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। একটা ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলতে চলতেই আরও ধর্ষণের ঘটনা সামনে চলে আসে।
ধর্ষণের এই অভাবনীয় বৃদ্ধির বৃহৎ সব কারণের ভিতর এটাও কি দায়ী নয়? যারা মূল ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র বিশ্লেষণে নেমে পড়েন তারাও অপরাধী নয়? যদিও এমন ঘটনা নতুন নয়। তবে এবার কিছু মুখোশধারীর নগ্নতায় একটু বেশিই লজ্জিত হয়েছি। এরাই সব সময় প্রকাশ্যে-গোপনে ঘটনার ভিতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যা ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। এরাও নির্যাতনকারী থেকে কম অপরাধী নয়। এদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা সময়ের দাবি।
রনি রেজা : সাংবাদিক