শেকড়কে মনে রাখতে হবে
তৌফিকুল ইসলাম
🕐 ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৮
শুভ্রা দেবনাথ রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী হলেও তার বিচরণ সংগীতের বিভিন্ন শাখায়। সংগীতের পাশাপাশি তিনি কলেজে শিক্ষকতা করেন। রবীন্দ্র সংগীতসহ বাংলাদেশের সংগীতচর্চা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন তৌফিকুল ইসলামের সঙ্গে।
সংগীত চর্চার শুরুটা কীভাবে হলো?
খুব ছোট বেলা থেকেই। না বুঝতেই কখন যেন দেখি পড়াশোনার মতো সংগীতচর্চাও আমার ডেইলি রুটিনের মধ্যে ঢুকে গেছে। পরবর্তী সময়ে নানান বড় বড় শিল্পীদের কাছে শেখার সুযোগ হয়, এখনো শিখছি।
রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কেন?
আমার ছোটবেলায় একবার বাবা ক্যাসেট প্লেয়ার এর সঙ্গে কনিকা বঙ্গোপাধ্যায়ের দুটো ক্যাসেট নিয়ে এসেছিল। মায়ের সঙ্গে ঘর গোছানোর কাজে জোরে সাউন্ড দিয়ে গান শোনা ছিল নিত্যসঙ্গী। কেমন করে যেন এ গানের প্রেমে পড়ে গেলাম। সে মোহ দিন দিন বেড়েই চলেছে কমছে না।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন তার গানে বেশ দারুণভাবেই ফুটে ওঠে। রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে বলুন...
রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো কত সহজ। যে কারণে আমার ছোটবেলায়ই ভালো লেগে গিয়েছিল। আমি দর্শন অনিচ্ছাকৃতভাবেই পড়েছি। তবে আমার দর্শন পড়া তখনই ভালো লেগেছে যখন আমি রবীন্দ্র সংগীতচর্চা শুরু করলাম। আমি দর্শনের ছাত্রী না হলে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতেও পারতাম না। রবীন্দ্রনাথ জীবনবাদী দার্শনিক ছিলেন। দুঃখ-বেদনায় রবীন্দ্রনাথ যা দেখেছেন তাই বলেছেন বিভিন্ন গান, উপন্যাসসহ তার নানা কাজের মধ্য দিয়ে। জীবনটা যখন দুঃখভারাক্রান্ত হয়, তখন সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথকে না পড়লে আমি দর্শন পড়াকে উপভোগ করতে পারতাম না। সব মিলিয়ে আমি বলতে পারি, রবীন্দ্র সংগীত আর দর্শন যেন একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করছে আমার জীবনে।
সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করেন?
আমি যদি সংগীতচর্চার সঙ্গে যুক্ত না থাকতাম, তাহলে হয়তো আমার মধ্যে সফটনেসটা থাকত না। শুদ্ধ সংগীতচর্চার কারণেই আমি ফিল করি শিক্ষক হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা অন্যদের তুলনায় খানিকটা আলাদা। আমি একাডেমিক ও সংগীতচর্চায় দুই ধরনের শিক্ষককেই পেয়েছি। আমার পছন্দের যে শিক্ষকরা আছেন, আমি তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি। তাদের প্রভাবও আমার মধ্যে আছে।
নতুন শিল্পীদের আপনি কি পরামর্শ দেবেন?
নতুন যারা আসছে, তাদের সব ধরনের গানই চর্চা করা উচিত। তারা সব গানই শুনবে, তবে নিজেদের শেকড়ের চর্চাটা তাদের করতে হবে। শেকড়কে মনে রাখতে হবে, শুধু পাশ্চাত্যের অনুকরণ করলে হবে না। শেকড়কে জানতে হলে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, লোকগীতি, পল্লীগীতি প্রভৃতি বাংলা গান তাদের চর্চা করতে হবে।
আপনি ভারতে সম্মাননা পেয়েছেন, সেখানকার টিভি প্রোগ্রামে বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিতও হয়েছেন। দুই বাংলার রবীন্দ্র সংগীতচর্চা নিয়ে বলুন...
দুই বাংলায়ই রবীন্দ্র সংগীত চর্চা হচ্ছে, তবে বাংলাদেশে বেশি চর্চা হচ্ছে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত, তাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও সেখানে ছোট একটা শ্রেণি রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করছে। সে তুলনায় ঢাকায় অনেক বেশি চর্চা হচ্ছে।
আমাদের জাতীয় সংগীত কলকাতায় রবীন্দ্র সংগীত হিসেবে চর্চা হয়, যে কোনো সময় তাদের টিভি চ্যানেলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রচার করা হয়। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত হওয়ায় আমাদের কাছে অনুভূতিটা সেরকম, আর তাদের কাছে প্রকৃতি নিয়ে সুন্দর একটা গান হওয়ায় তাদের অনুভূতিটাও আরেক রকম। তবে তারা খুব সুন্দর করে কোরিওগ্রাফি করেই গানটির ভিডিও নির্মাণ করেছে। আর গানটির ক্ষেত্রে চারটি দিক লক্ষণীয়, এটি বাংলা গান, প্রকৃতির গান, এবং গানে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
পশ্চিম বাংলার চ্যানেলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতিটা বলুন...
আমার খুব বেশি কাজ করার সুযোগ হয়নি। আমরা যখন অন্য দেশে যাই, তখন সবাই অনেক আশা করে। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সময় আমার মধ্যে দায়িত্ববোধ কাজ করে। তবে আমি বলব আমাদের বাংলাদেশি শিল্পীদের কলকাতায় সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ তাদের শিল্পীদের এ দেশে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অর্থাৎ ৯/১০/১১টার সময় কলকাতার শিল্পীদের লাইভ প্রোগ্রাম করা হয়, কিন্তু কলকাতার চ্যানেলে আমাদের সে সুযোগ দেওয়া হয় না। দেখা যায় যে, সেখানে আমাদের প্রোগ্রাম প্রচার করা হয় সকালে বা সন্ধ্যা ৬টার দিকে।
আসলে আমরা নিজেরাই কিন্তু আমাদের সম্মান করি না। কলকাতার শিল্পীদের যে সম্মান দেখাই, সে তুলনায় আমাদের শিল্পীদের সম্মান করা হয় না। অথচ এখানে সংগীতচর্চা বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পীরা কাজ পাচ্ছে না, সেখানে আমাদের বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে কলকাতার শিল্পীদের ৯/১০টায় লাইভ প্রোগ্রাম করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমরা কলকাতায় যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি, অথচ দেখা যায় যে তাদের সব বেসরকারি চ্যানেল বাংলাদেশে হয়তো দেখাও যায় না।
বাংলাদেশ-ভারত সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে মৈত্রীর বিষয়ে বলুন...
অবশ্যই, দুই বাংলার সংস্কৃতি এক। কাঁটাতার এক না, তবে এক মনকে তো ভাগ করা যায় না। দুই বাংলার সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।