ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রবচনচর্চার নতুন দিগন্ত

শফিক হাসান
🕐 ২:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২১

প্রবচনচর্চার নতুন দিগন্ত

মুন্সীগঞ্জের কৃতী সন্তানরা নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে। সরকার মাসুদ, সালাম সালেহ উদদীন, যাকির সাঈদ, অনু ইসলাম, সুমন ইসলাম, সাহাদাৎ রানা, প্রয়াত দুই সহোদর রতনতনু ঘোষ ও নিখিলেশ ঘোষ থেকে শুরু করে মাসুদ অর্ণবের সরব বিচরণ লক্ষণীয়। এর বাইরেও নিশ্চয়ই আরও সৃষ্টিশীল মানুষ রয়েছেন। মাসুদ অর্ণব মূলত কবিতা লেখেন, সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ‘খড়কুটো’। সম্প্রতি নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রকাশিত হয়েছে তার ‘প্রলাপগুচ্ছ’। প্রলাপের নামে নামে গ্রন্থভুক্ত করেছেন জীবনঘনিষ্ঠ কথামালার।

বাংলাদেশে প্রবচনচর্চার উল্লেখযোগ্য নাম কবি ও কথাসাহিত্যিক সালাম সালেহ উদদীন। তার সম্পাদিত ‘অরুন্ধতী’ লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ। পরবর্তীকালে প্রবচনগুচ্ছ বর্ধিত কলেবরে, বই আকারে প্রকাশ করে আগামী প্রকাশনী। এরপর প্রবচনের আরও কয়েকটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। সালাম সালেহ উদদীনের দুটি প্রবচনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- অমৃত কথা (শোভা প্রকাশ) ও ১০০০ অমৃত কথা (মিজান পাবলিশার্স)। আরও কয়েকটি বইয়ের মেলে- রতনতনু ঘোষের কথাচিরন্তন (অঙ্কুর প্রকাশনী), সৈয়দ শিশিরের প্রবচনগুচ্ছ (প্রকাশ পাবলিকেশন্স)। কুমিল্লার আলী আশরাফ খান একসময় প্রবচনের চর্চা করেছেন।

বর্তমানে ফেসবুকে হামীম কামরুল হক, রণজিৎ সরকারসহ কেউ কেউ প্রবচনচর্চা করছেন। কবি-গল্পকার মাসুদ অর্ণবের ‘প্রলাপগুচ্ছ’র আঁতুড়ঘরও ফেসবুক। জীবনকে গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোকনের ক্ষমতা, পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে বিচক্ষণ উপলব্ধি জন্ম দেয় প্রবচনের। সচরাচর প্রবচন স্বতন্ত্রভাবে লেখা হয় না। খ্যাতনামা লেখকদের রচনার সম্মোহনী একটি কালক্রমে বাণীতে রূপ নেয়। গল্প, উপন্যাস, কবিতা এমনকি প্রবন্ধের মাটিগন্ধী পঙক্তিও প্রসাদগুণে ফিরতে পারে মুখে মুখে। বাক্য সব শ্রেণির মানুষের অন্তর্কথন হয়ে উঠলে পায় স্বতন্ত্র মাত্রা। একপর্যায়ে রূপ নেয় প্রবাদে। এসব ক্ষেত্রে কমই মেলে রচয়িতা বা কথকের হদিস।

স্বতন্ত্র প্রবচন তেমন লেখা হয়নি। বাংলাদেশে সচেতনভাবে প্রথম প্রবচন লিখেছেন সম্ভবত হুমায়ুন আজাদ। এরপর অন্যরা প্রবচনের কয়েকটি বই লিখলেও পাঠকমনে খুব একটা রেখাপাত করেনি। ব্যতিক্রম বাদে প্রবচনচর্চা আলোচনায় আসেনি। সর্বশেষ মাসুদ অর্ণব’র ‘প্রলাপগুচ্ছ’ বইয়ে স্থান পেয়েছে ২০৭টি প্রবচন।

সমাজ-প্রতিবেশকে তির্যকভাবে দেখার অভীপ্সা ও অন্তরে জ্বালা না থাকলে প্রবচনের জন্ম হয় না। রাষ্ট্রীয় বর্বর ব্যবস্থা, চাতুর্যপূর্ণ পরিপার্শ্ব একজন সংবেদনশীল লেখককে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। লেখক তাড়িত ও পীড়িত হন। অন্তরজ্বালা সাময়িকভাবে মেটাতে মাসুদ অর্ণব ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করেননি। সংকীর্ণ পরিসরে না থেকে প্রবচনগুলোকে দিয়েছেন সর্বজনীন রূপ। যাপিতজীবনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলব্ধিগুলোই হয়ে উঠেছে আগুনের ফুলকি, অন্ধকারে বাতিঘর। অল্প কয়েকটি শব্দে ফুটিয়ে তুলেছেন সুগভীর ব্যঞ্জনা। পরিশীলিত জীবনবোধ ও ভাবসম্পদের ব্যবহার পাঠককে ঋদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। প্রলাপগুচ্ছ দেখাবে চেনা ভুবনের অচেনা জানালা।

প্রাত্যহিক আপাত তুচ্ছ বিষয়গুলোও ধরা দেবে নতুনরূপে। লৌকিক-অলৌকিকের সীমারেখা ডিঙিয়ে সন্ধান দেবে অপ্রতিম মানসের। ‘প্রলাপগুচ্ছ’র প্রথম প্রবচনটি হচ্ছে- ‘ভেসে থাকতে পারলে তীরের দেখা পাওয়া যাবেই একদিন’; শেষটি- ‘তোমাকে ডোবাতে পারে অস্থিরতা, ভাসিয়ে রাখতে পারে ধৈর্য’। এভাবেই শুরু থেকে শেষপর্যন্ত রকমারি বচনে পাঠককে ভাসিয়েছেন-ডুবিয়েছেন। গভীর জীবনবোধের প্রকাশ ঘটেছে এসব প্রবচনে। ‘সস্তা হওয়া সহজ, সহজ হওয়া কঠিন’ প্রবচনে লেখক আলোকপাত করেছেন সহজ-কঠিনের বাতাবরণে। ‘প্রতিবাদ ঘুমালে অপরাধ জেগে থাকে’ প্রবচনের মাধ্যমে উঠে এসেছে গভীর জীবন-সত্য। অপরাধ দমনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রতিবাদ, সেই প্রতিবাদ বন্ধ হয়ে গেলে বাড়ে অনাচার।
‘জীবনকে কঠিন বললে, জীবন হাসে।
জীবনকে সহজ বললে, জীবন হাসে।’

এতে ধরা পড়েছে জীবনের স্বরূপ। জীবন যে আসলে কঠিন নয়, সহজও নয়- সমীকরণ মিলবে অন্য কোথাও এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন লেখক। ‘সুখে থাকার ওষুধ সন্তুষ্টি’ বচনের মাধ্যমে সুখী জীবনের পথই নির্দেশ করেছেন। ‘অজ্ঞতা আর আবেগের সঙ্গে জন্ম নেওয়া বিশ্বাসই অন্ধবিশ্বাস’- সামাজিক কু-আচার, মৌলবাদের আস্ফালন প্রভৃতির বীজতলা এই অন্ধবিশ্বাস কিংবা ‘স্বেচ্ছা অন্ধত্ব’। এমন অন্ধত্ব ঘটনা-রটনার জন্ম দিচ্ছে নিয়ত।

‘দুঃখের মতো আপন নেই, সুখের মতো পর নেই’ উক্তি বাংলাদেশের বাস্তবতা ছাপিয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। এভাবেই স্বদেশ, সমকাল ছাড়িয়ে লেখকের পর্যবেক্ষণ হয়ে ওঠে সব শ্রেণির মানুষের অন্তর্কথন। ‘হালকা জিনিস অধিক প্রচারে ভারী হয়, ভারী জিনিস অধিক প্রচারে হালকা হয়’- বর্তমানের অতিপ্রচার ও অতিকথনের কুফল এবং অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের নেপথ্য চিত্র উঠে এসেছে এই বক্তব্যে। ‘হঠাৎ বড়লোক হওয়া যায় না, হঠাৎ ধনী হওয়া যায়’ দর্শন-সারাৎসারে লেখক বুঝিয়েছেন বড়মানুষ ও ধনী মানুষের মধ্যকার পার্থক্য। ধনী লোককে বড়লোক বলার অপসংস্কৃতি পুরনো। এটা যে শব্দের ভুল প্রয়োগ সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

এভাবেই মাসুদ অর্ণব দুই মলাটের ভেতরে পাঠককে যে পৃথিবী পরিভ্রমণ করিয়ে আনেন তাতে রয়েছে দীর্ঘ দিবস-রজনীর অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের নির্যাস। লেখকের বোধ ও বোধি সঞ্চারিত হয় পাঠকমননেও। পকেট সাইজ বইটি সহজে এঁটে যাবে যে কোনো মানুষের বুকপকেটে। কেউ বুকের সীমানা ডিঙিয়ে মনে বইটির নিগূঢ় বাক্য ধারণ করতে পারলে নিজেরই লাভ। লেখকের সার্থকতা তো বটেই। প্রলাপের মোড়কে লেখক যেসব অন্তর্ভেদি বাক্য উচ্চারণ করেছেন, সেই সব বক্রোক্তি-ব্যঙ্গোক্তি-সরলোক্তি সংবেদনশীল মানুষকে কখনো স্বস্তি ও শান্তি দেবে আবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও ফেলে দেবে আচম্বিতে। বইটি আর্ট পেপারে ছাপা। পরিপাটি বাঁধাই, ঝকঝকে মুদ্রণ।

সব ভালোর ভেতরে বানান ভুলের উপস্থিতি বেমানান। আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল। প্রবচন বাছাইয়েও আরেকটু সতর্ক থাকা যেত। ‘অজ্ঞতা জ্ঞানের জননী’ কিংবা ‘গভীর প্রেমে শব্দ কম’ এমন কয়েকটি উক্তিকে তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়েছে। অল্প কিছু ত্রুটি বাদ দিলে মাসুদ অর্ণব ও প্রকাশকের প্রশংসাই করতে হয়, শাণিত প্রবচনগ্রন্থটির জন্য।

প্রচার সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, এগারজন

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper