ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লেখার ‘মেশিন’ রতনতনু ঘোষ

শফিক হাসান
🕐 ২:৩৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২১

লেখার ‘মেশিন’ রতনতনু ঘোষ

খোলা কাগজে কলাম লিখতে আসবেন একজন লেখক, লিখবেন অফিসে বসে, কিন্তু অফিসে পৌঁছানোর আগেই চলে গেলেন চিরতরে! এমন ট্র্যাজেডিপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হতে চাইনি। অথচ সেটাই হয়ে গেল। খোলা কাগজের প্রায় প্রথম থেকেই নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। রোববারের প্রথম পোস্টটি ছাপা হতো তার। কম্পিউটারের ব্যবহার জানতেন না, তাই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাগজে লিখেই লেখা দিতেন। মাঝে-মধ্যে খোলা কাগজে আসতেন। কী নিয়ে লিখতে হবে জেনে অফিসে বসেই লিখে দিতেন। লেখা ছোট হলে আমরা বলতাম, আরও দুই-এক পৃষ্ঠা লিখুন। আপনার জন্য নির্ধারিত স্পেস ভরবে না এতে। সমাপ্ত হওয়া লেখার দিকে তাকাতেন না। শেষের পরে আরও লিখে সমাপ্ত করতেন। এমন বিরল প্রতিভা, যে কোনো বিষয়ে উপরে তাৎক্ষণিক লিখতে পারার ক্ষমতার জন্য আমরা তাকে উপাধি দিয়েছিলাম ‘লেখার মেশিন’ হিসেবে। এই মেশিনও বিকল হয়ে গেল একদিন!

যায়যায়দিন দফতরে বসে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সালাম সালেহ উদদীনকে দুই সপ্তাহের কলাম লিখে দিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে কল করলেন আমাকে। প্রশ্ন করলেন, ‘কীসে আসব, রিকশায় নাকি বাসে’ জানালাম, রিকশার ভালো পথ নেই। বাসেই আসা যাবে সহজে। যথারীতি সেদিনও রওনা হয়েছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত আর পৌঁছানো হলো না। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ডে। তরতাজা একজন মানুষের এমন চলে যাওয়া এখন রক্ত ঝরায় বুক থেকে। মোহাম্মদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী তার সংস্পর্শে এসেছে। এজন্য কোথাও ‘একা’ থাকতে পারতেন না। কেউ না কেউ এসে সালাম দিত কিংবা জিজ্ঞেস করত, কেমন আছেন! হাসিমুখে উত্তরও দিতেন তিনি। আগন্তুক নিরাপদ দূরত্বে গেলে বলতেন, কাকে বলল বলতাম, ‘আমি যেহেতু চিনি না, আপনাকেই বলেছে।’ এভাবেই আমরা একটা ‘সন্দেহ’র সঙ্গে ঘুরতাম। কেউ এসে সম্ভাষণ করলে, চিনতে না পারলেও সেটা কখনই প্রকাশ করতেন না রতনতনু ঘোষ। ভাবতেন, আমার পরিচিত। এক জীবনে এত বেশি মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে তাকে, সবাইকে তো মনে রাখতে পারবেন না। ‘চিনতে পারছি না’ এমন কথাও তিনি কখনো বলেননি। কষ্ট দিতে চাননি কারও মনে। তার সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল কাজের মাধ্যমে। যেখানেই যেতেন সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন আমাকে। মূলত প্রবন্ধ লিখতেন। কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য তার অপ্রিয় ছিল না, কিন্তু এসব পড়তেন না তেমন। যদিও তার অনেক লেখক বন্ধু ছিল। বাসস্ট্যান্ডে, নানান জায়গায় পরিচিত কোনো কবিকে দেখলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতাম তার। এড়িয়ে যেতেন তিনি। বলতেন, ‘না, না; কথা বলার দরকার নেই!’

একসময় নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করেন রতনতনু ঘোষ! আমরা অবাক হই। নিজের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক পরিচয়ে গর্ববোধ করা মানুষটি কেন কবিতা লিখবেন! কবিতায়ও তিনি ‘দিগন্তপ্লাবী’। এক বসায় লিখে ফেলতেন অনেক কবিতা। কবিতা লেখার পর আমাকে পড়তে দিতেন। কখনো-সখনো ঠাট্টা করে বলতাম, ‘একসঙ্গে এত কবিতা লিখলে কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় নাকি!’

তিনি এমন তত্ত্ব মানতেন না। অনেকেই একটা লেখার জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করেন। এসবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রতনতনু ঘোষ এক বসাতেই লিখে ফেলেন অনেক কবিতা, কলাম, প্রবন্ধ। তিনি লিখেছেন প্রচুর, সেই অনুযায়ী মূল্যায়িত হননি। সৎ মানুষ অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হন। তিনিও সেই সততার বলি। আগের কথায় ফিরি। যেখানেই যেতেন তিনি, পরিচিত অনেকেই এসে জুটত। খোলা কাগজে কলাম লিখতে এলেন একবার। আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার কাজী ফয়সাল এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘স্যার, কার কাছে এসেছেন’ তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি তোমাদের কাগজে কলাম লিখি।’ অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকও তার বন্ধু। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতে রতনতনু ঘোষ চেনেন না কিংবা তাকে চেনেন না, এমন মানুষ কমই আছেন। কবিতা লেখা শুরুর পর ‘কাব্যকলাম’ নামে নতুন ধারার কলামের প্রবর্তন করেন। কবিতার ভাষ্যে কলাম লিখতেন। পরে বিভাস প্রকাশনী থেকে বই বের হয় কাব্যকলাম নামে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চ’র একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। শাহবাগেই একসময় নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘গণকবিতা মঞ্চ’। ভ্রাম্যমাণ মানুষ থেকে শুরু করে যে কেউ এখানে কবিতা পাঠ করতেন। সন্ধ্যার পরপরই তিনি জাতীয় জাদুঘরের সামনে বসে কবিতা লিখতেন, পড়তেন। আরও কবির সঙ্গে আড্ডা হতো। হতো কবিতা বিষয়ে আলোচনা। রতনতনু ঘোষের আলোকচিত্র তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। পরবর্তীকালে তার সব বইয়েই আমার তোলা আলোকচিত্র স্থান পেত। নিজের ক্যামেরা ছিল না। এর-ওর কাছ থেকে ধার করে ক্যামেরা নিয়ে তুলতাম পছন্দের ছবি, পছন্দের মানুষের ছবি। রতনতনু ঘোষের অকালমৃত্যু আমার আলোকচিত্রী সত্তায় তুমুল ঝাঁকুনি দিয়েছে। এখন ছবি তুলি না, তুলতে ভালো লাগে না। তবে যত জায়গায় রতনতনু ঘোষের ছবি ছাপা হয়, গুগলে যত ধরনের ছবি মেলে তার অধিকাংশই আমার তোলা। একজন লেখকের সঙ্গে মৃত্যু হয়ে গেছে উদীয়মান এক আলোকচিত্রীরও।

লেখক হিসেবে তিনি যেমন চমৎকার ছিলেন, তেমনি ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও। চারপাশের মানুষকে ভালোবাসতেন। যে কারণে তার কাছে এসে বিমুখ হতে হয়নি কাউকে। নানাভাবেই মানুষের পাশে থেকেছেন তিনি। লড়েছেন মানুষের জন্যই। তার পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ প্রকাশনা করার কথা ছিল। কাজও গুছিয়ে এনেছিলাম। অকাল মৃত্যু সেই ‘আনন্দ’ প্রকাশনা আর হতে দিল না। পরে সিদ্ধান্ত হলো স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের। হায়, সেখানেও জটিলতা। একপর্যায়ে মারা গেলেন তার ছোট ভাই নিখিলেশ ঘোষ। যার স্বপ্ন ছিল দাদার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের, সেই তিনিও বিদায় নিলেন! আমাদের জন্য থেকে গেল শুধু বলক ওঠা শোক, যে শোকে আমরা কাতরাই- ডুবি-ভাসি। কী দুর্ভেদ্য-দুঃসহ এক চক্র...।

প্রচার সম্পাদক
কেন্দ্রীয় কমিটি, এগারজন

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper