একজন অনন্য শিক্ষক
শফিক হাসান
🕐 ৩:২২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৭, ২০২১
বুদ্ধিজীবীর ভিতরে-বাইরে থাকে অন্যায় সুবিধা ভোগের পাঁয়তারা, চরিত্রে সুবিধাভোগীর পাপ! কেউ কেউ অবশ্যই ব্যতিক্রম; তারাই ‘বুদ্ধিজীবী’ নামক ভারী শব্দটির মহিমা বজায় রাখেন। বিকশিত করেন মানুষের মনন, দেশ-কাল সমাজের অভ্যন্তরীণ ভূগোল পাল্টাতে নিরলস কাজ করে যান। বর্তমানের যে উল্টো যাত্রা, তাতে অনেক শব্দেরই অর্থ পাল্টে গেছে। শব্দ অনুযায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে গেলে হোঁচট খেতে হবে বারবার! তবুও কেউ কেউ অলোকসামান্য হয়ে থেকে যান। হয়ে ওঠেন আশা-ভরসার বাতিঘর।
বাংলাদেশের অনন্য একটি বাতিঘরের নাম আনিসুজ্জামান। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক; তারপর জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত। নানাভাবেই ঋদ্ধ করে গেছেন জাতির মনন-মনীষা। তাকে নিয়ে কী লেখা যায়, কীভাবে লেখা যায়! কোত্থেকে শুরু, কোথায়ইবা শেষ করতে হবে- পূর্বপশ্চিম এক হয়ে যায় কারও কারও ক্ষেত্রে। আনিসুজ্জামান স্যার তেমনই একজন। তাকে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন অভিহিত করেছিল ‘বাংলাদেশের শিক্ষক’ বলে। অভিধায় দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তার শিক্ষার্থী কে নন! কেউ সরাসরি পাঠ নিয়েছেন শ্রেণিকক্ষে, বিপুল সংখ্যক মানুষ পরোক্ষভাবে।
খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছাত্রী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল বছর কয়েক আগে। অনুষ্ঠানে বসে আছেন আনিসুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রী তার সামনে দাঁড়িয়ে কুশলাদি বিনিময় করছেন। অন্য কেউ হলে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াতেন কিন্তু আনিসুজ্জামান অন্য ধাতুতে গড়া। বুঝিয়ে দিলেন শিক্ষকের মর্যাদার জায়গা কত উঁচুতে! দুজনই প্রশংসিত হয়েছিলেন এমন দৃশ্যে।
প্রথম আলোতে আত্মজীবনীমূলক ধারাবাহিক রচনা ‘বিপুলা পৃথিবী’ পাঠের মাধ্যমে আমার আনিসুজ্জামান পাঠ শুরু। এরপর কাছাকাছি আসা, ঘনিষ্ঠতা। বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন তিনি, নানা কারণেই ওই প্রতিষ্ঠানে আমার দীর্ঘ যাতায়াত ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে চালু হওয়া তরুণ লেখক প্রকল্পের শিক্ষার্থীও ছিলাম। এ সুবাদেও স্যারের সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। রাজধানীতে উল্লেখযোগ্য যত অনুষ্ঠান হয়, অনেকটারই সভাপতি থাকতেন স্যার। ‘প্রতিদিন একটি খুন’ আমার প্রথম গল্পগ্রন্থের ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তার কার্যালয়ে গেলে, নিজস্ব প্যাডে লেখাটা দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমার চলবে কিনা!’ এটা শুধু বিনয় নয়, তার স্নেহও। স্যার এমনভাবে লেখেন যাতে কেউ খুশি-বেজার কোনোটাই না হয়! অযাচিত প্রশংসা করতেন না কারওরই। যেদিন ফ্ল্যাপ আনতে যাই, আমার সামনেই খ্যাতনামা দুজন অধ্যাপক তার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। আরও বরেণ্য মানুষের আনাগোনাও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল। যাদের আমরা ‘স্যার’ ডাকি, বুদ্ধিজীবী হিসেবে সম্মান করি আনিসুজ্জামান স্যার তাদেরও শিক্ষক! কী অবিশ্বাস্য কান্ড কীর্তি সব।
অনেকেরই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার এমন ফ্ল্যাপ লেখার রহস্য উদঘাটন করে দিয়েছিলেন তিরোধানের পর। স্যার অযাচিত প্রশংসা করতেন না, কৌশলী অবস্থানের কারণে অনেক তরুণ লেখকই আনন্দিত হতেন। প্রশংসা-নিন্দা না করেও যে সঠিক কথাটি বলা যায়, সেই চর্চাই আমৃত্যু করে গেছেন আনিসুজ্জামান। বছরখানেক আগে ‘কালি ও কলম’ কার্যালয়ে স্যারের জন্য একটা বই দিয়ে এসেছি। পরদিনই অবাক করে দিয়ে কল করলেন- ‘শফিক হাসান, তোমার বইটা পেয়েছি। আমি অবশ্যই পড়ব।’ তুচ্ছ একজন মানুষের বই পড়ার সময় স্যারের হবে, এমন দুরাশা করি না। কিন্তু প্রাপ্তি স্বীকার করে যে উদারতার পরিচয় দিলেন সেটাও ভোলার নয়। বাংলাদেশের যে কোনো প্রগতিশীল আন্দোলনে, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় স্যারের ভূমিকা অগ্রণী।
বিভিন্ন ম্যাগাজিনের জন্য শুভেচ্ছা বাণী কিংবা নিজের লেখা কখনই বড় করতেন না। কিন্তু যেটুকু লিখতেন বা বলতেন তাতে ‘কম হয়েছে’ বলার সাধ্য ছিল না কারও। সাংবাদিকতার সুবাদে মাঝে-মধ্যেই কল করতে হতো স্যারকে। বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য নেওয়ার। কল রিসিভ করে তিনি যেভাবে বলতেন, ‘কী খবর, কেমন আছ’ মন শীতল হয়ে যেত। যেন অনেকদিনের চেনা, খুব ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে আলাপ করছেন!
আনিসুজ্জামান স্যার অতুল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তার সৃষ্টিকর্মে খুঁজে পাওয়া যায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিচ্ছবি। যে মানচিত্র ও ভূগোলের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন নিরলস। বয়সী একটি বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় স্থান পেয়েছি একদা, অহংকারের জায়গাটুকু অমলিন থাকুক! এমন অনন্য একজন শিক্ষকের সংস্পর্শ নিশ্চয়ই সুখস্মৃতির ভাণ্ডারে মূল্যবান সম্পদ।
প্রচার সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি
এগারজন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228