ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ই ফ তা র

আরাফাত শাহীন
🕐 ২:২৬ অপরাহ্ণ, মে ২৩, ২০১৯

এক.
পশ্চিম আকাশে বিকালের শেষ আলোটুকু ঝুলে রয়েছে। আর কিছুক্ষণ পরেই এই আলো মুছে গিয়ে নেমে আসবে অন্ধকার। মোতালেব পা টেনে টেনে শহরের পিচঢালা গনগনে গরম রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলছে। বারবার সে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাচ্ছে- এই বুঝি সন্ধ্যা নেমে আসে, আর মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে ইফতারের আহ্বান। আজানের আগেই তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে হাজির হতে হবে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করার কথা রয়েছে জহিরের। জহির ছেলেটাকে নিয়ে হয়েছে এক যন্ত্রণা। একা থাকলে কোনো ঝামেলা নেই। এক থেকে দুই হলেই এই জগতে ঝামেলার সূচনা হয়। অথচ কী আশ্চর্য! এই জগতে কেউই একা থাকতে পছন্দ করে না। দুনিয়াতে একমাত্র মানুষই বোধহয় যেচে নিজের ঘাড়ে ঝামেলা নিয়ে আসে।

জহির মোতালেবের ছেলে। তাকে ছেলে বলাও বোধহয় ঠিক হবে না। একদিন এমনই গরমের দিনে শহরের দোকানগুলোতে ভিক্ষা করছিল মোতালেব। গরমে ভিজে যাচ্ছে তার পুরো শরীর। ভেজা, নোংরা পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে বারবার মুখের ঘাম মুছছে সে। এমন সময় ছোট্ট একটা ছেলে এসে তার পাঞ্জাবির কোনা ধরে টান দিল।

মোতালেব ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার নিরপদ্রুব জীবনে হঠাৎ করে কোনো ঝামেলার উদয় হোক তা বোধহয় সে চাচ্ছিল না। তবুও সে ছেলেটিকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেনি। দোকানির কাছ থেকে খুচরো এক টাকার দুটো কয়েন নিয়ে ফিরে তাকিয়েছিল ছেলেটির মুখের দিকে। শুকনো মুখখানা দেখলেই বোঝা যায়, পেটে দানাপানি পড়েনি কিছুই। কয়দিন না খেয়ে আছে তা কে জানে! পরনে পাতলা ফিনফিনে একটা প্যান্ট; তাও বোধহয় ছিঁড়তে বাদ নেই কোথাও। গায়ে জামা নেই কোনো, একদম খালি গা। সেই খালি গায়েও রাজ্যের ময়লা, ধুলো লেগে একাকার হয়ে আছে। এই ছেলেটি কেন যে মোতালেবের কাছেই এলো তা কিছুতেই সে ভেবে বের করতে পারল না।

মোতালেব ভিড়ের মধ্যে থেকে ছেলেটিকে এক কোনায় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘নাম কী তোর? কী চাস আমার কাছে?’ ছেলেটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে। তারপর একটা ভাতের হোটেলের দিকে ইশারা করল। মোতালেব যা বোঝার বুঝে নিল এক নিমিষেই। থলের মধ্যে হাত দিয়ে দেখল, যা জমা হয়েছে তা দিয়ে এক প্লেট ভাত আর কিছু সবজি পাওয়া যাবে। নিজের পেটে সকাল থেকে এই দুপুর অব্দি দানাপানি পড়েনি। তবুও এই ছেলেটিকে না খাইয়ে রাখা যায় না।

খাওয়া শেষ হলে মোতালেব ছেলেটির হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে দিল। তার মানে, এখন তুমি তোমার পথ দেখ। কিন্তু সে নড়ল না একচুলও। মোতালেবের নোংরা, তেল চিটচিটে পাঞ্জাবির কোনা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ভারী মায়া হলো মোতালেবের। তার কাছে মনে হলো, আহা! এই ছেলেটিও বোধহয় জগতে তার মতো অসহায়। মোতালেব ছেলেটিকে নিজের ডেরায় ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ছেলেটিকে নিয়ে একটা মুসিবত হয়েছে। সে কথা বলতে পারে না। জন্ম থেকেই বোবা। এই বোবা ছেলেটি এখন তার কাছে বোঝা হয়ে পড়েছে। সে নিজেই তো কোনোমতে চলে! মোতালেব তার একটা নাম ঠিক করে দিল। জহির। নাম ধরে ডাক দিলে সে বুঝতে পারে। কোনো উত্তর দিতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

জহির এখন আগের চেয়ে খানিকটা বড় হয়েছে। আগে মোতালেব তাকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করতে বের হতো। এখন আর সঙ্গে নেওয়া লাগে না। জহির একা একাই যেতে পারে। কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আসে।

দুই.
আজকে গরমের মাত্রা অন্য দিনের চেয়ে বেশি। মোতালেবের কাছে ভয়ানক বলে মনে হচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে রমজান মাসে নিয়মিত রোজা রাখে সে। কিন্তু আজকের মতো গরমে এত কষ্ট সে কোনো দিনও পায়নি।

তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চায়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। আজকে শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। আয়ও হয়নি তেমন একটা। জহির কতটুকু পেয়েছে কে জানে! আগে রমজান মাসে মানুষ দান-খয়রাত করত প্রচুর। এখন আর আগের মতো করে না। সবাই শুধু উপার্জন করতেই ব্যস্ত।

মোতালেব ক্লান্ত শরীর নিয়ে পূর্বের নির্ধারিত জায়গায় এসে হাজির হয়। জহির এখনো আসেনি। মোতালেবের দুশ্চিন্তা হয়। তার তো আগেই আসার কথা ছিল! ছেলেটি আবার পথ ভুল করে বসল না তো!

ক্লান্ত শরীর নিয়ে সে বসে পড়ে রাস্তার এক পাশে। রাস্তা দিয়ে স্রোতের মতো মানুষ চলাচল করছে এখনো। কিন্তু কারও দিকে তাকানোর সময় কারও নেই। মোতালেব মনে মনে ভাবে, হাশরের মাঠে মানুষের নাকি এমন অবস্থা হবে।

কিছুক্ষণ বাদে সে দেখতে পায়, দূর থেকে পা টেনে টেনে জহির আসছে। আজকে সেও রোজা রেখেছে। মোতালেব মানা করে বলেছিল, তুই এতটুকু মানুষ। তোর রোজা না রাখলেও চলবে। জহির তবুও জিদ ধরে বসেছিল। রোজা সে রাখবেই। পরে মোতালেব আর না করেনি। জহিরের মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে বড় কষ্ট হয়েছে তার। মোতালেব ইফতারি নিয়ে একটা কাগজের ওপর সাজানো শুরু করে। অতি সামান্য সামগ্রী। কিছু ছোলা, দুটো চপ, দুটো পেঁয়াজু আর টিউবওয়েল থেকে আনা এক বোতল ঠাণ্ডা পানি।

সেটাও সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আনতে হয়েছে। মোতালেব মনে মনে ভাবে, সুযোগ পেলে মানুষ এই পানিরও দাম রাখত।

ইফতার সাজানো দেখে জহিরের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে ওঠে। শুকনো মুখটাতে সেই হাসিটা অদ্ভুত এক দৃশ্যের অবতারণা করে। মোতালেবের বড় ভালো লাগে এই দৃশ্য। কিছুক্ষণ পরেই মসজিদ থেকে ভেসে আসে ইফতারের আহ্বান। বাপ-বেটা মিলে সামান্য এই খাবারটুকুও তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নেয়। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে মুহূর্তেই সতেজ হয়ে ওঠে পুরো দেহ-মন। মোতালেবের মনে হয়, হঠাৎ করে গরমের ভাবটাও যেন পুরোপুরি মিলিয়ে গিয়েছে।

সভাপতি
এগারজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper