ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চিঠি

নাজনীন সুরভী
🕐 ১২:৩৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০১৯

 

সৈকত,
আজ হঠাৎ করেই তোমাকে লিখতে বসলাম। মাঝে কয়েকটা বছর কেটে গেছে। মনের কোণে ধুলাবালি জমেছে। অবচেতন মনে ঝাড়তে গিয়েই তোমার ছবিটা স্পষ্টভাবে ভেসে উঠল। পুরনো একটা চিনচিনে ব্যথা উঠল যেন বুকে। কিছুটা উপশম করতেই হয়তো তোমাকে লিখছি। জানি, স্বার্থপর বলবে। আর বলবে নাইবা কেন? টাকা,বাড়ি,গাড়ি,ঔদার্য্য যে ভালোবাসার কাছে জলাঞ্জলি দিতে পারেনি, সে স্বার্থপরই তো।

কেমন আছ জিজ্ঞাসা করাটা হবে আমার বিনয়। কিংবা তোমার গায়ে সে কথা শূলের মতো বিঁধবে। কিন্তু বিশ্বাস করো ঘাত-প্রতিঘাতের ইচ্ছে আমার নেই। তোমার সঙ্গে লড়াইয়ে আমি হেরে গেছি। জিতে গেছে তোমার সাদাসিধে তেজোদ্দীপ্ত জীবন। বছরখানেক আগে তোমার রুমমেট জহির ভাইয়ের সঙ্গে বনানীর একটা শপিংমলে দেখা হয়েছিল। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন - ও বেচারীর কথা আর বলো না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে গ্রামের বাড়িতে একটা হাইস্কুলে বিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি নিয়েছে।

কোথায় শহরে একটা ভালো বেতনের চাকরি করবে, আরাম-আয়েশে দিনযাপন করবে, তা না করে গ্রামে ঘাঁটি গেড়েছে। ধরে ধরে মানুষের বাচ্চা মানুষ করতে লেগেছে। বুদ্ধিটা ওর আর হলো না। সেদিন আমি অবাক হইনি জহির ভাইয়ের কথা শুনে। চিরটাকাল তোমাকে ধীরস্থির থাকতে দেখেছি। জীবনের জটিলতার হিসাব কষতে তোমাকে কখনো দেখিনি। সব হিসাবই ছিল তোমার কাছে সরল অঙ্ক। তোমার প্রতি খুব ঈর্ষা হতো-খুব সহজে সবকিছুর সমাধান করে ফেলতে বলে। অথচ আজ আমাকে দেখো। জীবনের জাঁতাকলে কেমন পিষে যাচ্ছি। নিজেকে বুদ্ধিমতি ভাবতাম। সুখগুলো এখন ঢাকা শহরের কংক্রিটের চার দেয়ালে বন্দি। জীবন এখানে যন্ত্রণাদগ্ধ। সময় ধরে চলে সবকিছু। দীর্ঘশ্বাস ফেলবার মতো সময় এখানে মেলে না। আপনার বলতে বুঝি কিছুই নেই।

সবুজ বন-বীথিকার মুক্ত আলো বাতাসের মাঝে তোমার দিনগুলো কেমন যায় খুব দেখতে ইচ্ছে হয়। শেকড়ের গল্প তুমি আমাকে সবসময়ই শোনাতে। তোমাদের শাপলা-ফোটা ঝিলের গল্প, শিউলীতলার গল্প, ঝিঁ ঝিঁ পোকার স্তব্ধ রাতের গল্প-আরো কত গল্প। অন্তরচক্ষু দিয়েই যেন তোমাদের গ্রামের একটা ছবি আমি অনায়াসেই এঁকে ফেলতাম। গল্প বলবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তোমার। তোমার দুরন্ত কৈশোর, বেড়ে ওঠা, ডানপিটেপনা সবকিছু আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। তোমাকে সুখী মানুষ মনে হতো। তোমাদের গ্রামের মানুষগুলোর অকৃত্রিম সরলতার গল্প আমাকে চুম্বকের মতো টানত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার সেসব গল্প বুদ্ধিজীবী চত্বরে বসে শুনতাম। পড়াশোনা শেষে গ্রামে গিয়ে একটা স্কুল দেবে- সেকথা তুমি প্রায়ই বলতে। তুমি বলতে-আগামী প্রজন্মই আমাদের সম্পদ। এরাই দেশের সম্পদ। সঠিক শিক্ষা আর নৈতিকতা দিয়েই এরা রুখবে অন্যায়, দুর্নীতি। তার দায়ভার তো আমাদেরই নিতে হবে। বলতে বলতে তোমার চোখের মণি চিকচিক করে উঠত। কি এক জ্যোতি যেন তোমার চোখ থেকে ঠিকরে পড়ত। তোমার মাঝেই এক তপস্বী পুরুষকে দেখতে পেতাম। নিজের সাধনায় ছিলে তুমি সবসময়ই অটল। আর তাই তো সময়ের প্রতিকূলেও তুমি আজ জয়ী। খুব ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ছি তোমার প্রতি।

তুমি কি আগের মতোই রয়ে গেছ? চিরুনি-বিরহিত উষ্কখুস্ক চুল কিংবা কালো মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে তোমার ভাবুকতাময় চোখ দুটো কি এখনো কি যেন খুঁজে বেড়ায়? মাস শেষে টিউশনির টাকা কি এখনো জমাও একটা স্কুল দেবে বলে? জানি, এসব জানতে চাওয়া এখন আমার সাজে না। কারণ অধিকারটুকু ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গাটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছি। নিচ ছেড়ে সহজে ওপরে ওঠা যায়। কিন্তু ওপর থেকে হুট করে নিচে নামাটা অতটা সহজ নয়। আমার চার বছরের সাংসারিক আর দায়িত্বের জীবনে সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। অ্যালার্মে ঘুম ভাঙে আর অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমুতে যাই। মাঝে জীবনের কর্মব্যস্ততা। জীবন কোনোমতে চলে যাচ্ছে কিন্তু জীবনের যাপিত রস এখানে পাই না। আমার সঙ্গে তোমার জ্যোৎস্না দেখবার ইচ্ছেটার মতোই একের পর এক ইচ্ছের চাপা দিয়ে আসে নতুন ভোর। নিয়মের এক বিশ্রী চক্রজালে আবদ্ধ। অথচ নিয়ম ভাঙার গান একদিন গেয়েছিলাম। সে ছিল কেবলই ফাঁকা আওয়াজ।

আমার শানশওকতময় জীবনে সাধারণের কাতারে তুমিই আমাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলে। উঁচু হিলে হাঁটতে গিয়ে কতবার চোট লেগেছিল। প্রতিবার তুমি বলতে-আরেকটু সহিষ্ণু হয়েছ তুমি। আরো অনেকটা হতে হবে। জীবনের পরতে পরতে সেই সঞ্চিত সহিষ্ণু এখন আমার খুঁটি। তোমার সাধারণ জীবন আমাকে যতটা না মুগ্ধ করত, তার চেয়ে বেশি শিক্ষা দিত। তোমার ঘর্মাক্ত শরীরও যেন আমাকে উদ্দামতার শিক্ষা দিত। তোমার ওই দুচোখের অবসাদে যেন আমি অনন্তকাল ধরে পুড়েছি। তোমার মুখের চাইতে ওই চোখ দুটোই যেন বেশি কথা বলত। সেই বিদায়বেলাতেও তোমার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছিলাম আমি। সারা পৃথিবী যেন তোমার চোখের অতল গহব্বরে সেদিন তলিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের ঘণ্টা হঠাৎই বেজেছিল।

সম্পত্তি, অর্থ প্রতিপত্তির কাছে তোমার এই ভক্ত সেদিন হার মেনেছিল। এর জন্য পুরোপুরিভাবে তুমি আমাকে দায়ী করতে পার না। বাবার জেদের কাছে আমার জেদ ছিল নগণ্য। চিরাচরিত পৃথিবীর নিয়ম মেনে আমার বাবাও সেদিন বলেছিল-তোমাকে সুখী দেখতে চাওয়াটা কি আমার অন্যায়? তুমি যাকে ভালোবাসো ওর তো ছাপোষা জীবন। তোমাকে কি করে সুখী রাখবে! ছক কেটে হিসেব কষে লাভের হিসেবটা আমিও খতিয়ে দেখেছিলাম সেদিন এক নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলাম তোমার স্বপ্নের জাল। তোমার স্তব্ধতাই সবচেয়ে ভারী ছিল সেদিন। হৃদয়ের অন্তঃস্তল থেকেই হয়তো আমার জন্য কেবল ঘৃণাই উৎসারিত হয়েছিল সেদিন। শুধু বলেছিলে-রেণু, আমি কেমন করে চলব বলতে পারো?

তোমার হৃদয়ের গভীরতা সেদিন বুঝতে পারিনি। কেবল মনে হয়েছিল-আর কিছু না? ওইটুকুই? ছাই ভালোবেসেছ আমাকে!

শুনেছি সংসারধর্ম তুমি পালন করোনি। শতবার নিজের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছি তোমার অটুট ভালোবাসার প্রতি সেদিন বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ ছিল বলে। আর আমি স্বার্থপরের মতো দিব্যি সংসার করে যাচ্ছি। কোনোকিছুর অভাব নেই। কেবল একফোঁটা সুখের অভাব। যদি তোমার মতো খুব সাধারণ হতে পারতাম, তোমার মতো দশ, দেশ নিয়ে ভাবতে পারতাম, ধিক্কারভারে নুয়ে যাওয়া মাথা কিছুটা হলেও উঁচু করতে পারতাম। স্বার্থপরেরর মতো এখনো কেবল নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার বুকের ওই। বেদনা সৈকতের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আমার বক্ষতটে আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
তোমার জন্য রইল নীরব সমর্থন। ভালো থেকো।

ইতি
রেণু

সহ-সভাপতি
এগারজন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper