তীব্র সেশনজটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
নাহিদুজ্জামান নাহিদ, বেরোবি
🕐 ১২:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২১
অস্থিতিশীলতা, দ্বন্দ্ব, আন্দোলন, সংঘর্ষ এবং ব্যাপক রাজনীতির আরেক নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে নানান ইস্যুতে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল ও দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকা, আন্দোলনের মুখে ভিসির পদত্যাগ, রাতের আঁধারে বাসভবনের পেছনের গেট দিয়ে ভিসি পলায়ন, ঢাকায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দৃষ্টান্ত বহন করছে উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ। ফলে দীর্ঘ সেশনজটের কবলে পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ ১২ অক্টোবর ১৪ বছরে পা রাখল।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৪ বছরে এসেও সংকটের তকমা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তীব্র সেশনজট, শিক্ষক সংকট, ক্লাসরুম সংকট, আবাসন সংকট, খেলার মাঠ সংকট, লাইব্রেরিতে বই সংকট, মেডিকেল সেন্টারে ওষুধ সংকট, পরিবহন সংকটসহ আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকেও বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইন্সটিটিউট নির্মাণ, ১০তলা বিশিষ্ট শেখ হাসিনা হল নির্মাণ, শহীদ মিনার, স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণ বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠার এত বছরেও হয়নি একটি পূর্ণাঙ্গ ফটক।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৩ বছরে সাবেক চার উপাচার্য দায়িত্ব পালন করে গেলেও এসব মৌলিক সমস্যা সমাধানে তেমনি কোনো নজর দেননি। কোনো উপাচার্য দুর্নীতির কারণে করেছেন কারাভোগ, কোনো উপাচার্য বাসভবনের পেছনের দরজা দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। আবার কেউ মেয়াদের অধিকাংশ সময় ঢাকায় কাটিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ১৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্রান্ডিং করতে উপাচার্যরা নানান স্বপ্ন দেখালেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বলে মত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয় যেসব মৌলিক সমস্যায় জর্জরিত:
তীব্র সেশনজট: প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই ভয়াল সেশনজটের কবলে পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বিভাগেই দেড় বছর থেকে সাড়ে ৩ বছরের সেশনজট। যার ফলে ৬ থেকে ৭ বছরেও শেষ হচ্ছেনা অনার্স। যা শিক্ষার্থীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে সেশনজট মুক্তের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বেশ কিছু বিভাগ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ রেখেছেন ক্লাস পরীক্ষা।
আবাসিক সংকট : সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি হল। যার মধ্যে ছেলেদের দুটি ও মেয়েদের একটি। আরেকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নির্মাণাধীন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যাপ্ত না থাকায় আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
শিক্ষক ও ক্লাসরুম সংকট : বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকবেন। জাতীয় পর্যায়েও দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ মানদণ্ড অনুসরণে উৎসাহিত করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ৩৯৩ জন। এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৮৮ জন। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৪৪। অর্থাৎ প্রতি ৪৪ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন একজন করে, যা বৈশ্বিক ন্যূনতম মানদণ্ড এমনকি জাতীয় পর্যায়ের গড় অনুপাত থেকেও অনেক বেশি। শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে রয়েছে তীব্র ক্লাসরুম সংকট।
উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতা : প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের দুটি ভবন শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ওয়াজেদ রিসার্চ ইন্সটিটিউট এখনো নির্মাণাধীন। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি কাজের উদ্বোধন হলেও এখন পর্যন্ত অসম্পন্ন। এমনকি স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে আছে। এখনো অস্থায়ীভাবে নির্মিত আছে শহীদ মিনার। এসব প্রকল্পে সাবেক উপাচার্যের দুর্নীতি প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কদর নেই রোকেয়ার : নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াতের নামে বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ হলেও কদর নেই রোকেয়ার! রোকেয়াকে জানতে ও তাঁর দর্শন চর্চায় একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন পেলেও ১৪ বছরেও চালু হয়নি রোকেয়া স্ট্যাডিজ। নেই কোনো ম্যুরাল। রংপুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রকে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে নেওয়ার দাবি থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
করোনাকালীন অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা : সেশনজট দূরীকরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য ড. হাসিবুর রশিদ অনলাইনে ক্লাস পরীক্ষা চালু করেন। এতে সেশনজট দূরীকরণে কিছুটা গতি সঞ্চার করলেও কিছু বিভাগ অনলাইন ক্লাস পরীক্ষার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এতে বিপদে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
প্রধান ফটক নির্মাণে টালবাহানা : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের চারটি গেট থাকলেও, নেই আকর্ষণীয় প্রধান ফটক। সাবেক ভিসি ড. কলিমউল্লাহ একটি প্রধান ফটক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও কাগজে কলমেই আটকে আছে বাস্তবায়ন।
হল-ক্যাম্পাস খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা : করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ বন্ধের পর ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কবে নাগাদ আবাসিক হল-ক্যাম্পাস খোলা হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বর্তমান প্রশাসন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ বলেন, নানান সংকটের মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ বছরে পদার্পণ করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সাহায্যে ২০২২ সালের মধ্যে দ্রুততম সময়ের সেশনজট মুক্ত করা হবে। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, আধুনিক চর্চাকেন্দ্র ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি সম্প্রসারণ করা হবে। সব সমস্যা দূরীকরণের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাবে বলে আশাবাদী।