ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুই সমাপনী স্থায়ীভাবে বন্ধ চান শিক্ষাবিদরা

বিশেষ প্রতিনিধি
🕐 ১২:৩৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২০

চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে না নিয়ে স্কুলে মূল্যায়ন আর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) সমাপনীর পরিবর্তে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও এ প্রস্তাবকে সাময়িক বলছেন কর্তাব্যক্তিরা। আর অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, এটি পরীক্ষা চালুর পর থেকেই বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার নানা যুক্তি দিয়ে পরীক্ষা দুটিকে জিইয়ে রেখেছে। করোনার এ সুযোগে পরীক্ষা দুটি চলতি বছরের জন্য নয়, স্থায়ীভাবে বন্ধ করার দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন অভিভাবকরা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে সম্মতির প্রয়োজন।

দুই মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা আসার পর পিইসি ও জেএসসি নামে দুটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করে। সেখানে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতো জিপিএ-৫ সহ অন্যান্য গ্রেড রাখা হয়। এতে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জিপিএ-৫ এর পেছনে ছুটতে গিয়ে কোচিং, নোটগাইডের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্কুলে শিক্ষকরা ক্লাসের চেয়ে কোচিং ব্যবসায় বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। এসব কারণে ২০১০ সালে করা আলোচিত জাতীয় শিক্ষানীতি ভেস্তে যায়।

আটকে গেছে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নেওয়া, নয় বছর ধরে আটকে আছে শিক্ষা আইন। শুধু কোচিং বাণিজ্যের কারণে শিক্ষানীতি ও শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। সংগঠনের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, বর্তমান কোচিং ব্যবস্থা বাণিজ্যিক রূপ নেওয়ার অন্যতম কারণ এ দুটি সমাপনী পাবলিক পরীক্ষা। কারণ প্রাথমিকে ৩০-৩২ লাখ জেএসসিতে ২২ থেকে ২৩ শিক্ষার্থীকে শিক্ষার্থী না বানিয়ে পরীক্ষার্থী বানিয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার কারণে বাধ্য হয়ে কোচিং করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

জানা গেছে, চলতি বছর দুই সমাপনী পরীক্ষা না নেওয়ার পাশাপাশি এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে শিক্ষা এবং প্রাথমিকও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেন করেছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। সম্প্রতি করা এ আবেদনে পরীক্ষা না নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের দাবি তুলে এবং হাই কোর্টের নির্দেশনা বিষয়টি জানানো হয়।

অভিভাবকরা বলছেন, পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে এবং কোচিংয়ে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে। সব মিলিয়ে অভিভাবকদের যেমন শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে, তেমনি শিশু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে। কেননা এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের সন কোনো কাজে আসছে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে শুধু এই বছর নয়, চিরতরে এই দুটি পাবলিক পরীক্ষা বা দেওয়া রকার। স্কুলে স্কুলে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল সাময়িক নয়, চিরস্থায়ী করার দাবি জানান তারা। দেশের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) জেএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার সুপারিশ করেছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দুটি সমাপনী পরীক্ষা চালু ফলে শিক্ষার্থী না হয়ে পরীক্ষার্থী হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরিবর্তে মুখস্থ নির্ভরতা বেড়েছে। এতে শিক্ষার সার্বিক মান কমে গেছে। মাধ্যমিকে আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া পক্ষে মত দেন তিনি। মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল পর্যায়ের বার্ষিক পরীক্ষাই একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই যথেষ্ট। ইংরেজি মাধ্যমের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেখানে মাধ্যমিকের আগে কোনো পরীক্ষা হয় না।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মনোবল বৃদ্ধি, বাছাই না করে সব শিক্ষার্থীদের সমানভাবে যতœ নেয়া, পরবর্তী পাবলিক পরীক্ষার ভয়ভীতি দূর করে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা জন্যই এ দুটি পরীক্ষা চালু হয়েছে, এমন যুক্তি দেয়া হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। কিন্তু পরীক্ষা দুটি শিক্ষার মানোন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা এখন দেওয়া হয়নি। শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, কোচিং ও নোট ব্যবসায়ী ছাড়া এদুই পাবলিক পরীক্ষা আর কোনো কাজে আসছে না। তারা বলেন, বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিকের জন্য পাঁচ বছর, মাধ্যমিকে পাঁচ বছর আর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য দুই বছর সময় বরাদ্দ করা আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও কম বেশি একই স্তরে বিভক্ত। প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কলেজে ভর্তি হতে গেলেও ভর্তি পরীক্ষা বসতে হয়, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলেও ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে এসএসসির ফল একটি মোটা দাগের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার ফল সম্মিলিতভাবে মোটাদাগের নিয়ামকের কাজ করে। এই নিয়ামক দিয়ে কারা ভর্তি পরীক্ষায় বসার যোগ্য হবে, সেটি ঠিক করা হয় কেবল। বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে ভর্তি পরীক্ষার ফলের।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল হোসেন বলেন, সমাপনী পরীক্ষা বাতিলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতির প্রয়োজন। আমরা চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা না নেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছি। তিনি হয়তো বিকল্প কোনো পদ্ধতি দিতে পারেন। সব কিছুই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর।

সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই তৃতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ হবে এমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি বছর দেশের ১০০টি স্কুল পর্যায়ে পাইলটিং হিসেবে এ কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। আর আগামী বছরে থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। যেহেতু এবার পাইলটিং হয়নি তাই আগামী বছরের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। চলতি বছর ধীরে ধীরে হয়তো সমাপনীর পরীক্ষা থাকবে না বলে আশা করেন তিনি।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির বলেন, মহামারীর কারণে এ বছর পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিলের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি এবং এটা যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সেই দাবিও করেছি।

 
Electronic Paper