একাদশে ভর্তিতে ‘ভুয়া’ আবেদনের হিড়িক
তোফাজ্জল হোসেন
🕐 ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৯, ২০২০
নরসিংদীর রায়পুরার সিরাজ নগর এম এ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন রাকিব মেহরাব। সদ্য চালু হওয়া কলেজ ভর্তির জন্য আবেদন করতে গিয়ে দেখেন একই এলাকার দুটি বেসরকারি কলেজ পর্যায়ক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ দিয়ে আবেদন করা হয়ে গেছে। অথচ এসব কলেজ ভর্তি হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। চিন্তিত পরিবার স্কুলের সহযোগিতায় ঢাকা বোর্ডে এসে তার আবেদন বাতিল করেন এবং নতুন করে আবেদন করেন। শুধু মেহরাব নয়, প্রতিদিন ঢাকাসহ অন্যান্য বোর্ডগুলোতে ‘ভূতরে আবেদন’ বাতিল করতে ভিড় করছেন অসংখ্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা বোর্ডে আবেদন বাতিলের জন্য আলাদা বুথ খোলা হয়েছে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে আলাদা কর্মকর্তা সংযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে সরজমিন ও অন্যান্য বোর্ডে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, সংযুক্ত স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এলাকাভিত্তিক কোচিং সেন্টার, ব্যক্তিগত শিক্ষক, পরীক্ষার কেন্দ্র, ফটোকপি দোকান থেকে শিক্ষার্থীদের রোল, রেজিস্ট্রেশনসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে কিছু ভুঁইফোড় কলেজ শিক্ষার্থীদের অজান্তে ভর্তির আবেদন করে রেখেছে। মূলত দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান এসব অনৈতিক কাজগুলো করছে। এরমধ্যে স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংযুক্ত এরকম প্রতিষ্ঠান এগিয়ে রয়েছে। দেখা যায় স্কুলের মান ভালো কিন্তু কলেজের মান ভালো না। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর সব তথ্য প্রতিষ্ঠানে থাকে।
শিক্ষকরা সেসব তথ্য নিয়ে কলেজে ভর্তির আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনেরশিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হতে অনিচ্ছুুক। রাজধানীর উত্তরা, সাভার, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো কিছু কলেজ গড়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে গড়ে ওঠা কলেজে শিক্ষার্থী সংকট রয়েছে। এসব অখ্যাত কলেজ স্কুল থেকে শিক্ষার্থীর তথ্য নিয়ে নিজেরা আবেদন করে। এসব এলাকার কলেজে ‘শিক্ষার্থী ধরা মানে শিয়াল ধরা’র মতো ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কিছু কলেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। তারাই এসব আবেদন করে শিক্ষার্থী টানার চেষ্টা করছেন। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড এ ধরনের প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে অভিভাবকদের অনুরোধ করেছে। কোনো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে বোর্ডের কন্ট্রোল রুমে ফোন করে সমাধান নিতে পারবেন। কিন্তু কন্ট্রোল রুমের ফোন সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকায় বাধ্য হয়ে সরজমিন বোর্ডে আসতে হচ্ছে অধিকাংশকে।
শরীয়তপুরের পঞ্চপল্লী জি.আর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা সুমাইয়া জাহান ও তার অভিভাবকরা এসেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। জিপিএ-৫ পাওয়া ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, পরীক্ষার আগে তিনি যে কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতেন সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সম্প্রতি তার রোল, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এমনকি বাবার জাতীয় পরিচয় নম্বর নেন। কোনো কারণ না জেনেই তিনি সব দিয়ে দেন।
তার অভিযোগ, তারাই আমার আবেদন করে দিয়েছে। যেসব কলেজকে পছন্দ দিয়েছে তার কোনটিই তিনি ভর্তি হতে চান না। আবেদন বাতিলের জন্য বোর্ডের কন্ট্রোল রুমে অনেকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন। তার সঙ্গে কলেজ পরিদর্শকের রুমে সামনে অন্তত প্রায় একই ধরনের অভিযোগ নিয়ে আরও শ’খানেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ভিড় করেছেন। তবে বোর্ডের কলেজ পরিদর্শনের কাছে একটি আবেদন করলেই খুব সহজেই ভর্তি বাতিল করে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ বলেন, গত বছর সাড়ে তিন হাজার ভুয়া আবেদনের অভিযোগ পেয়েছিলাম। এ বছর এখন পর্যন্ত ছয় শতাধিক আবেদন পেয়েছি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ পেলে দ্রুত ভুয়া ভর্তির আবেদন বাতিল করে নতুন করে আবেদনের সুযেগ দেওয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুয়েটকে চিহ্নিত করতে বলেছি। প্রথমে কোন ফোন নম্বর দিয়ে আবেদন করা হয়েছে সেটা চিহ্নিত করা হবে। অভিযুক্ত কলেজকে কারণ দর্শানো হবে। প্রয়োজনে পাঠদানের স্বীকৃতি স্থগিত করা হবে।
ঢাকা বোর্ডের বাইরে অন্যান্য বোর্ডেও চলছে শিক্ষার্থীর অজান্তে একাদশে ভর্তির আবেদন। চট্টগ্রাম বোর্ডের অধীনে ৪৬টি কলেজের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যনুযায়ী, বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ায় ২০১৭ সালে ‘ভুঁইফোড়’ কলেজগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিলো। ঢাকা বোর্ডের অধীনে এ ধরনের ৯৮টি, যশোর বোর্ডের অধীনে ছয়টি। রাজশাহী বোর্ডে ৫০টি। চট্টগ্রাম বোর্ডে চারটি, সিলেট এবং বরিশাল বোর্ডে সাতটি, দিনাজপুর বোর্ডে ৩২টি। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন বোর্ডে ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) চিঠি পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা পরিপত্র জারি করা হয়েছিলো। কিন্তু বোর্ডগুলো শুধু শোকজ করে দায়িত্ব শেষ করেছিল। ঢাকা বোর্ডের কারণ দর্শানো ৮৯টি কলেজের নাম জানা গেছে।
গতকাল পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি আবেদন
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন শুরুর প্রথম ধাপে এখন পর্যন্ত সারা দেশের ১২ লাখের বেশি ভর্তিচ্ছক আবেদন করেছেন। আর শুধু ঢাকা বোর্ডের কলেজগুলোতেই আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত এ আবেদন পড়েছে। গত ৯ আগস্ট সকাল সাতটা থেকে চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে অনলাইন ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হবে। ভর্তিচ্ছুরা থেকে অনলাইনে আবেদন করতে পারবে। নগদ, সোনালী ব্যাংক, টেলিটক, বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা যাবে।
একজন কমপক্ষে ৫টি ও সর্বোচ্চ দশটি কলেজে পছন্দক্রম অনুসারে আবেদন করতে পারবে। পছন্দক্রম অনুসারে নির্দিষ্ট কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত করা হবে। ১ম, ২য় ও তৃতীয় দফায় আবেদন, মাইগ্রেশন শেষ করে কলেজভিত্তিক চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হবে ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায়। ভর্তি চলবে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।