উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ওয়ালিয়ার রহমান
🕐 ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৬, ২০২০
করোনাভাইরাসের কারণে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতায় আছে দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী। গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ধাপে ধাপে ছুটি আরও বাড়তে পারে। কবে খোলা হবে এখনো অনিশ্চিত। ফলে উচ্চশিক্ষা স্তরে ভয়াবহ সেশনজটে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতি পোষাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলেও কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব একটা সাড়া মিলছে না। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাও শুরু করেছেন তারা।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, স্বায়ত্তশাসিত ৪টিসহ ৪৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও আমাদের মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও কর্মজীবনে অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর পিছিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে তা বলা যাচ্ছে না। এ জন্য দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনের আওতায় ক্লাস কার্যক্রম শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাদের সক্ষমতা নেই ইউজিসির সহযোগিতায় সেই পরিবেশ তৈরি করতে বলা হয়েছে। ছুটি দীর্ঘায়িত হলেও বিশ^বিদ্যালয়গুলো যেন সেশনজটে না পড়ে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, সব নীতিনির্ধারককে নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও অনেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে টালবাহানা শুরু করছেন। অনেকে ছুটির দিনে বাড়তি ক্লাস করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কারও ওপর চাপ দেওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্নভাবে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সাপ্তাহিক ছুুটির দিন ও অন্যান্য সময় অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের এই সময়ে সক্রিয় রাখা এবং খোলার পরপর যাতে কম সংখ্যক ক্লাস নিয়েই পরীক্ষা শুরু করা যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সেশনজট রয়েছে। তাই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সভাপতিদের সঙ্গে অনলাইনে ক্লাস চালুর ব্যাপারে আলোচনা করেছি। তবে জরিপ চালিয়ে দেখেছি, ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনোভাবেই অনলাইন ক্লাসে আগ্রহী নয়। তাই এই সংকটের সময়ের পরে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ও সাপ্তাহিক ছুটি একদিন কমিয়ে সেশনজট নিরসনের চেষ্টা করব বলে পরিকল্পনা করেছি।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজের দুই লক্ষাধিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২২৬০টি কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী এবং কয়েকটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সেশনজটে পড়বে।
এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ খোলা কাগজকে বলেন, আমরা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করে যেভাবে সেশনজট ওভারকাম করেছি, করোনা পরিস্থিতিতে একই মেথড অ্যাপ্লাই করা হবে। ফলে সেশনজটের আশঙ্কা নেই। তাছাড়া আমাদের অধিভুক্ত কলেজগুলোকে অনলাইনে ক্লাস নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেক কলেজই ক্লাস শুরু করেছে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলব, তারা যেন বাড়িতে বসে পড়ালেখা করে।
লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (দায়িত্বপ্রাপ্ত) শ্রীযুক্ত বনমালী ভৌমিক বলেন, আমরা ইউজিসির অনুমতি ও নির্দেশনা অনুযায়ী অনলাইনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু করেছি। চলতি সেমিস্টারের একাডেমিক কার্যক্রমকে যুক্ত করে তত্ত্বীয় কোর্সের অনলাইন পাঠদান সম্পন্ন করে এই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পঠিত অংশের ওপর অ্যাসাইনমেন্ট, কেইস স্টাডি, (ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে), ভার্চুয়াল প্রেজেন্টেশন ও ভাইভা ইত্যাদির সমন্বয়ে অনলাইন পরীক্ষার কার্যক্রম চলবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সেশনজটের কবলে পড়বে না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল খোলা কাগজকে বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের নানারকম সর্বনাশ করেছে এবং করে যাচ্ছে, কিন্তু এক ধাক্কায় লেখাপড়ার বড় একটা অংশ তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় চলে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কেউ যেন মনে না করে সেটা সত্যিকারের স্কুল-কলেজ কিংবা ক্লাসরুমের জায়গা নিতে পারবে- সেটি কখনো হবে না, ধরে নিতে হবে এটা হচ্ছে একটা বিপর্যয়ের সময়ের জন্য ঠেকা দেওয়া, সবাইকে একটুখানি ব্যস্ত রাখা। আমি আশা করছি দেখতে দেখতে এই বিপদ কেটে যাবে এবং আবার স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মুহাম্মাদ আল-মাহদী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষ একপ্রকার অনিশ্চয়তায় ভুগছে। মানুষের স্বাভাবিক কর্মকা- যেখানে ব্যাহত হচ্ছে, সেখানে অনলাইন ক্লাস কতটা কাজে আসবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি ৩০ শতাংশেরও কম। নেটওয়ার্ক না থাকা, মোবাইল অপারেটরগুলোর উচ্চমূল্য, শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার দিকটি সামনে উঠে এসেছে। ফলে সেশনজটের শঙ্কায় আছি।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বুশরা তাবাসসুম ঐশী বলেন, গত সপ্তাহ থেকে আমাদের অনলাইনে পাঠদান শুরু হয়েছে। কিন্তু আমি কোনো দিনই শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখিনি। কারণ হিসেবে আমি মনে করি অনেক শিক্ষার্থীর গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়া। ইন্টারনেট ও লোডশেডিং সমস্যা তো আছেই। তাছাড়া বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ক্লাস না করে পরীক্ষা দেওয়া কঠিন হবে। কাজেই অনেকের ইয়ার ড্রপ বা সেমিস্টার লস হতে পারে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এ কে এম রহমত উল্লাহ কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ বলেন, আমার অনার্স ফাইনাল (চতুর্থ বর্ষ) চূড়ান্ত পরীক্ষা গত মার্চ মাসে শুরু হয় এবং তিনটি সম্পন্ন হলে করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আরও পাঁচটি পরীক্ষা ও ভাইভা রয়েছে এগুলো কবে শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করব এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছি।