ফের ইবির নিয়োগ বাণিজ্য, অডিও ফাঁস
ইবি প্রতিনিধি
🕐 ১০:৪২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৮
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। প্রার্থীর সঙ্গে ২০ লাখ টাকার চুক্তি হয় নিয়োগ বাণিজ্যকারীদের। বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ চুক্তির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে অডিও থেকে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক প্রার্থীর সঙ্গে ওই বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সম্মতিতে নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।
ক্যাম্পাস ও অডিও সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি বিভাগে ৩৭ শিক্ষক নিয়োগে ২৪১তম সিন্ডিকেট চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। পরে প্রার্থী নিয়োগ নিয়ে অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়ে যায়। নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থী ১০ লাখ টাকা নগদ এবং বাকি ১০ লাখ টাকা চেকে দিয়েছেন। তবে ওই প্রার্থীর নিয়োগ নিশ্চিত না করতে পারায় টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। গত ১৩ জুলাই রাতে ওই প্রার্থীর স্বামীকে ফোনে ডেকে নিয়ে টাকা ফেরত দিয়েছেন বলেও অডিওতে বলা হয়েছে।
এর আগেও ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও রেকর্ড গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই অডিওতে ১২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছিল। প্রার্থীর স্বামী শাহরিয়ার রাজ বলেন, ‘চাকরির ৯৯ শতাংশ কনফার্ম করেছিল বলেই টাকা দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর আর চাকরির বয়স নেই। আমি তাদের বিচার চাই।’
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’ রেকর্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত।’
অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘রাজনীতি করার কারণে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তবে আমি কারও জন্য কখনো ভিসি স্যারের কাছে সুপারিশ করিনি।’
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এরকম কিছু প্রমাণিত হলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আমি জানি না ওই প্রার্থীর নিয়োগ হয়েছে কিনা। তবে আমি এমন ধরনের কোনো বিষয়ে জড়িত নই।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারী বলেন, ‘যদি এ ধরনের কোনো চুক্তি তারা করে থাকে, সেটি কার্যকর হোক বা না হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অসৎ এবং অশুভ চুক্তি করার জন্য অভিযোগ আকারে এলে আমরা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনব। আমি দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স জারি করেছি। সব দুর্নীতি, অনিয়ম বর্তমান প্রশাসন দূর করবেই।’
অডিও রেকর্ডের অংশ বিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
ড. বাকী বিল্লাহ : এ মামুন ভাই আপনি আসতিছেন?
ফারজানা : আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ, দেখ বাবু আমি...।
ফারজানা : স্যার আমি তো আপনাদের কথা শুনে অনেকখানি একদম ডিপেন্ডেবল। যে কালকে আপনারা আমাকে এত করে বললেন, জাহাঙ্গীর স্যার যখন বলল আপনাকে, আপনার মাধ্যমে টাকাটাও ডিল-ট্রিল করবে। আপনার কথা শুনে আমি একদম ২০ লাখ টাকাও হাতে ধরায় দিলাম। তুলে দিলাম। আশা করলাম। স্যার কেন এমনটা করল? জাহাঙ্গীর হোসেন স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : এখন আমি তোমার স্যারের সঙ্গে এতক্ষণ বসে থেকে কথা বললাম।
ফারজানা : স্যার তো সিগনেচার না করলে নিয়োগ হতো না। স্যার তো আমাকে বলতে পারত। আমাকে আরও অ্যামাউন্ট দেওয়া লাগত। আমি তাতেও রাজি ছিলাম।
ড. বাকী বিল্লাহ : না না, ওসব না, ওসব না। মনি, ওসব কোনো কিছুই না।
ফারজানা : তাহলে কেন আপনারা আমাকে কনফার্ম দিলেন? আমি রিটেনে ভালো করলাম। ভাইভাতেও ভালো করলাম। আমাকে সব আশ্বস্ত করে দিলেন। আর এখন শেষ মুহূর্তে এসে এমন করলেন আপনারা আমার সাথে।
ড. বাকী বিল্লাহ : এখন কুষ্টিয়া থেকে তোমাকে বলি, হয়তো অন্য কারও হয়েছে বা, যা হোক আমি তো বলতে পারব না।
ফারজানা : কুষ্টিয়ার ক্যান্ডিডেট তো আমিই ছিলাম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হুম, আরে বাবা আরও ক্যান্ডিডেট আছে।
ফারজানা : নুসরাত ছিল। নুসরাতের কি হইছে?
ড. বাকী বিল্লাহ : সেটা বলতে পারছি না।
ফারজানা : স্যার কাইন্ডলি, আপনারা যদি একটু দেখতেন...।
ড. বাকী বিল্লাহ : আরে বাবু...। না না, আমি তো জাহাঙ্গীর স্যারের সঙ্গে এখনই উঠে এলাম। এখন এই জিনিসটা এখনই আবার। মামুন ভাই জিনিসটা বারবারই জানতে চাচ্ছে। আমি কিন্তু তাকে জানাচ্ছিলাম না। আমি তাকে পরে জানাব। কালকে সিন্ডিকেট হবে। সিন্ডিকেটের পরে জানাব। কিন্তু আগে জানিয়েই আমি আরও বিব্রত হলাম দেখছি।
ফারজানা : জি স্যার, আপনি আমাকে কনফার্ম করলেন। তোমার এইটটি পার্সেন্ট হয়ে গেছে। তোমার কোনো অসুবিধা নেই। এর জন্য আপনি যখন যে শর্ত দিয়েছেন, টাকা দেওয়া বলেন, জাহাঙ্গীর স্যারের... কোনো সত্যতা যাচাইও করতে যায়নি। আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা পে করে দিয়েছি। সব করে দিয়েছি স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : সেটা নিয়ে তো আর সমস্যা নাই। আমরা তো কোনো মিস ইউজ করিনি। জাহাঙ্গীর স্যার তো এটা মিস ইউজ করেননি। তাই না? এখন সে না পারলে, আমি তো মাঝখানে থেকে মানুষের উপকার করে এখানে তো কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
ফারজানা : জাহাঙ্গীর স্যার এটা করত না?
ড. বাকী বিল্লাহ : পারত কিনা সেটা আমার জানা নেই। রাতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। সরি বলেছেন উনি। এখন কী করব বলো? কিছু করার নেই বাবু। মামুন ভাইকে, আমি তো বসে আছি। উনি এলে আমি তো উনাকে পৌঁছে দিয়ে...
ফারজানা : আচ্ছা আপনি উনার (স্বামী) সঙ্গে কথা বলেন।
(এবার স্বামীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন এগিয়ে দেন ফারজানা)
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ।
ফারজানার স্বামী : হ্যালো...।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ, মামুন ভাই ভয় পাচ্ছেন কেন? কুষ্টিয়ার ছেলে। আপনি আসেন। আমি তো আপনাকে নিজে পৌঁছে দেব। কী মুশকিল রে ভাই... মানুষের উপকার করতে গিয়ে আমি নিজেই তো একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছি।
তদন্ত কমিটি গঠন
শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসের ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারী এ কমিটি গঠন করেন।
তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, ছাত্র উপদেষ্টা ও বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আক্তারুল ইসলাম জিল্লু। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করতে বলা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম আব্দুল লতিফ বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ।’
ইবির শিক্ষক হচ্ছেন জাবির সেই ছাত্রী!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) রেজাল্ট নিয়ে বিতর্কিত সেই ছাত্রী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। ওই শিক্ষার্থীর নাম আতিফা কাফি। ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে বিভাগের শিক্ষকদের ছত্রছায়ায় রেজাল্ট ভালো করার অভিযোগ রয়েছে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৪টি বিজ্ঞাপিত পদে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রশাসন। এতে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং তিনজন লেকচারার নেওয়া হবে।
গত ৫ জুলাই ওই বিভাগের নিয়োগ বোর্ডে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বোর্ডে ৫৬ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্য ২৪ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় পাস করে মৌখিক সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করেন।
এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আতিফা কাফি লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষা শেষে ওই নিয়োগে আতিফাকে চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন উঠেছে। নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী, প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. শাহিনুর রহমান, বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. নাসিম বানু। বোর্ডে বহিরাগত বিশেষজ্ঞ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ইলিয়াস হোসেন।
জানা যায়, আতিফা কাফি জাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের (৪১ ব্যাচের) ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। স্নাতক পরীক্ষায় তার রেজাল্ট ৩.৫১। মেধাক্রম ১১তম। অভিযোগ রয়েছে, বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক এবং পরীক্ষা কমিটির সভাপতির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। বিভাগে ইতিহাস গড়ে সিজিপিএ পান ৩.৯৭।
তিনি স্নাতকোত্তর পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় সভাপতির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করে মেধাতালিকায় প্রথমে উঠে আসেন বলে অভিযোগ করেন সহপাঠীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওইসময় সহপাঠীরা জাবি ভিসি বরাবর আতিফার খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে লিখিত প্রতিবাদ লিপিও দেন। গত ৬ মার্চ আবেদনটি ভিসি বরাবর পৌঁছায়।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি ড. জেবুন্নেসা বলেন, ‘আমি নিজে বিষয়টাকে বিতর্কিত মনে করে একটি তদন্ত কমিটি চেয়েছি। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। যেহেতু এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন সেহেতু আমি মনে করি, বিষয়টা সুরাহা হয়নি। তাই ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বিষয়টি সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।’
এ ছাড়া ওই প্রার্থীর রেজাল্ট বিতর্ক নিয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ফলে এর আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়োগ হয়নি বলেও জানা গেছে। বিতর্কিত ছাত্রী ইবিতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে নতুন বিভাগটি শুরুতেই বিতর্কের জন্ম দেবে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী বলেন, ‘এরকম অভিযোগ সিন্ডিকেটের আগে পেলে সে কোনোভাবেই পার পাবে না। এমনকি নিয়োগের পরেও এমন অভিযোগ পেলে তার নিয়োগ বাতিল করা হবে। এমন সৎ সাহস আমার আছে।’