ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তড়িতাহতে আবরারের মৃত্যু

পাহাড়সম প্রশ্ন

শফিক হাসান
🕐 ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০২, ২০১৯

তড়িতাহতে শিক্ষার্থী নাইমুল আবরারের (১৫) মৃত্যুতে ফুঁসে উঠেছে তার সহপাঠীরা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা। গত শুক্রবার দৈনিক প্রথম আলোর সহযোগী প্রকাশনা কিশোর আলোর (কিআ) এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার। বিকালে অনুষ্ঠান মঞ্চের পেছনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আবরারের মৃত্যুর পরও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ম্যাগাজিনটির সম্পাদক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন; কিশোর আলোর ফেসবুক পেজেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে ঘটনার আদ্যোপান্ত। যদিও এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি শিক্ষার্থীরা।

শনিবার প্রথম আলোর কাছে শিক্ষার্থীরা চারটি দাবি তুলে ধরেছে। আবরারের সতীর্থরা ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে এসব দাবি জানায়। সেখানে শিক্ষার্থীরা লিখেছে- ‘একটা ছেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দুঃখিত, মৃত্যু না- তাহসান-অর্ণবের সুরের মূর্ছনার ভিড়ে একটা ঠাণ্ডা মাথায় খুন হয়ে গিয়েছে। পনেরো বছরের একটা বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছে, এই জরুরি খবর জানানোর চেয়ে গান চালানোই জরুরি মনে হয়েছে তাদের। ...১২ ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও যখন আনিসুল হক নামক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায় না, বরং, ‘ধাতস্থ হলে বলব’ উত্তর আসে, তখন বোঝাই যায়, তাদের ধাতস্থ হওয়ার অর্থ ঘটনা ধামাচাপা পড়া। এবার এসেছি নিজেদের দাবি-দাওয়া জানাতে। কিছু সুস্পষ্ট দাবির জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তারপর আমরা পিছু হটার কথা ভাবব, তার আগে পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই।’

শনিবার দুপুরে শিক্ষার্থীরা চারটি দাবি জানায়- ঘটনা চলাকালীন সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে হবে; অনুষ্ঠানের মিস ম্যানেজমেন্টের দায় স্বীকার করে কিশোর আলো, ইভেন্ট অর্গানাইজার, ইউনিভার্সেল মেডিকেল (পূর্বনাম আয়শা মেমোরিয়াল হাসপাতাল) কর্তৃপক্ষের লিখিত বক্তব্য দিতে হবে; ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ছাত্রদের হাতে পৌঁছাতে হবে; শুধু দুর্ঘটনা নয়, তাদের গাফিলতি, মিস ম্যানেজমেন্ট এবং উদাসীনতা উল্লেখ করে পত্রিকায় উল্লেখ করে বিবৃতি দিতে হবে।

আবরারের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে যথাসময়ে চিকিৎসা না করার বিষয়ে। পার্শ্ববর্তী হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি না করিয়ে কেন দূরের ইউনিভার্সেল মেডিকেলে নেওয়া হলো- শিক্ষার্থীসহ সবারই একই জিজ্ঞাসা। সাহিত্যিক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক এ বিষয়ে গত শুক্রবার রাত ১টা ৩৫ মিনিটে ফেসবুকে নিজের ওয়ালে লিখেছেন- ‘...কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন, আমার জন্য এর চেয়ে শোক, দুঃখ, পরিতাপের বিষয় আর নেই। নাইমুল আবরার ঢাকা রেসিডেনসিয়ালের ক্লাস নাইনের ছাত্র ছিল। ভালো ছাত্র ছিল। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ...অনুষ্ঠান শেষ হয় ৪টা ৪০ কি ৪টা ৪৫। ৫টার পর আমি জানতে পারি, আহত জন মারা গেছে। মানে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার ১৫/২০ মিনিট পরে মৃত্যুর খবর পাই। তারও আধ ঘণ্টা পর আমাকে জানানো হয়, যে মারা গেছে, তিনি ক্লাস নাইনের ছাত্র, রেসিডেনসিয়ালের ছাত্র। কাজেই যারা বলছেন, নাইমুল আবরার মারা যাওয়ার খবর গোপন করে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা ঠিক বলছেন না। শেষ শিল্পী অর্ণব ওঠার আগে দুর্ঘটনা সম্ভবত ঘটেনি।

সম্ভবত বলছি, কারণ একেকজন একেকটা কথা বলছেন। দ্বিতীয়ত, ইউনিভার্সেল হাসপাতাল আমাদের স্পন্সর নয়। তারা আমাদের জরুরি মেডিকেল সার্ভিস দেওয়ার জন্য ওখানে ছিলেন। দুজন এফসিপিএস ডাক্তার ছিলেন। একটা অ্যাম্বুলেন্স রেডি করা ছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সেই নাইমুল আববারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কেন তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলো না, এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আমরা যে মেডিকেল ক্যাম্প, টিম, অ্যাম্বুলেন্স রেডি রেখেছিলাম, সেটা ভালোর জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা থাকা সত্ত্বেও নাইমুল আবরার আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমরা স্তব্ধ, বিধ্বস্ত। শোকাকুল।’

আবরারের মৃত্যুতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি করেছে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় কলেজের মূল ফটকের বাইরে মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীরা। গতকালের মানববন্ধনে ‘আমার ভাই মারা গেল, কিশোর আলো চুপ কেন’, ‘কিশোর আলোর অমানবিকতা, মানি না মানব না’ স্লোগান দেয়।

শিক্ষার্থী বিক্ষোভের একপর্যায়ে অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ উপস্থিত হন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে আমরা সেটাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করি। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। ইতোমধ্যে এক জরুরি সভার মাধ্যমে আমাদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন পেলে তারই পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তাদের অনাকাক্সিক্ষত কিছু না করার জন্য বলা হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যক্ষ।

গত শুক্রবার রাতে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মাঠে আবরারের জানাজা শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ধন্যপুর গ্রামে নেওয়া হয়। গতকাল সকালে সেখানে জানাজা শেষে তার দাফন হয়। জীবদ্দশায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন আবরার।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিজি বিশ্বাস জানান, আবরারের পরিবারের আবেদনে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ‘উল্লাসে আড়াল আবরারের মৃত্যু’ শিরোনামের কলামে তুষার আবদুল্লাহ লেখেন- ‘...অনুষ্ঠানের উল্লাস-আনন্দে তারা ভাটা টানেননি। যে পত্রিকার নামে অনুষ্ঠান, তার ভোক্তা আবরার।

আবরারদের জন্যই পত্রিকাটি নানা প্রতিশ্রুতি, জীবন গড়ার রকমারি বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়। তাই যার বা যাদের জন্য এই পত্রিকা, সেই বয়সী একজনের মৃত্যু হলো ওই পত্রিকার অনুষ্ঠানে, তার জন্য সুরের ঝঙ্কার থেমে গেলে, ওই পত্রিকার প্রতি পাঠকদের ভালোবাসা বাড়তই। ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত একটা আফসোস রয়েই যায়- যারা হলি আর্টিজানে নিহত ফায়াজের মানবিকতাকে ব্র্যান্ডিং করে মানবতার আলো অনির্বাণ রাখতে চান, তারা আবরারের মৃত্যুর খবরটি প্রথম পাতায় এনে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন। করেননি বলে আলোটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল।’

নাইমুল আবরারের মৃত্যুতে প্রশ্নের যে পাহাড় জমেছে, তাতে ‘লাভেলো-কি আনন্দ’ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হচ্ছে না সাধারণ মানুষ। দুর্ঘটনায় নিহত এক আবরার, সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নির্যাতনে নিহত আরেক আবরারের পর স্কুলশিক্ষার্থী আবরারের মৃত্যু কাঁদাচ্ছে-ভাবাচ্ছে দেশের মানুষকে।

 
Electronic Paper