ভেঙে পড়ছে সবকিছু, ভ্রুক্ষেপ নেই ভিসির
ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯
ফাতেমা-তুজ-জিনিয়ার বহিষ্কারের ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দানা বেঁধেছিল ভিসি খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের উত্তাপ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে। শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। শিক্ষকদের এক অংশ শামিল হয়েছেন ভিসি নাসিরের স্বেচ্ছাচারী আচরণ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। একে একে তিনজন সহকারী প্রক্টর এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। নিশ্চুপ ইউজিসিও সরব হয়ে তদন্তে নেমেছে। বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে এসব প্রলয়ের মধ্যেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিসির নিপীড়নের শিকার ছাত্র-ছাত্রীদের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ চলমান আন্দোলন। ভিসি বাহিনীর হামলা, ভয় ভীতি, হুমকি, এমনকি ঝড় বৃষ্টি কোনো কিছুই থামাতে পারছে না শিক্ষার্থীদের। গতকাল বৃহস্পতিবার এ আন্দোলনের অষ্টম দিন পেরিয়ে গেছে, দিন রাত ২৪ ঘণ্টার বিরামহীন আন্দোলনেও ক্লান্তি নেই কারও।
এদিকে এ আন্দোলনের জন্য মিডিয়াকে দায়ী করেছেন ভিসি নাসির। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাংবাদিকেরা নিউজ কাভার করা বন্ধ করলে, এই আন্দোলন দুই ঘণ্টায় সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ওরা (শিক্ষার্থীরা) লোভ সামলাতে পারছেন না। ওরা ভাবছে, ‘সারা দেশে আমাদের ছবি দেখা যাচ্ছে, আমরা তো নেতা হয়ে যাচ্ছি।’
ভিসির এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জিনিয়া খোলা কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীরা রাত দিন ২৪ ঘণ্টা ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। তবুও তারা হাল ছাড়ছেন না। শুধু গণমাধ্যমে দেখানোর জন্য কেউ এতটা ত্যাগ শিকার করবে না। কেউ যদি নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তার জন্য তো সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এখানে একাডেমিক ক্যারিয়ারের ওপর হুমকি নিয়ে বসে আছেন, তাদের সেশনজট মোকাবেলা করতে হতে পারে। তারা হামলার শিকার হয়েছে, আবারও হামলার শিকার হতে পারে। উপাচার্য যদি পদত্যাগ না করেন, আন্দোলনকারীরা ভবিষ্যতে তার ক্ষোভের শিকার হতে পারেন। এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও তারা মাঠে আছেন।
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ‘কথায় কথায় বহিষ্কারপ্রবণ’ ভিসির কারণে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে। তার নিপীড়নের কারণে ২০১৭ সালে অর্ঘ্য বিশ্বাস নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও একটি জাতীয় দৈনিকের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে অন্যায়ভাবে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন ভিসি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনিয়ার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন, ভিসির পুত্তলিকা দাহ, মশাল মিছিলসহ কর্মসূচি পালন করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় বাংলাদেশ ক্যাম্পাস জার্নালিস্ট ফেডারেশন। ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় এবং শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। ওই দিন রাতেই চার শিক্ষার্থী (জাহাঙ্গীর আলম, আবু তাহের, শেখ তারেক, বাবুল শিকদার) ফেসবুক লাইভে এসে ভিসির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম তুলে ধরে ভিসির পদত্যাগ দাবি করেন।
ওইদিন রাতে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে প্রথম মিছিল শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মিছিলের বহর আরও বাড়তে থাকে। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, কেলেঙ্কারিসহ ১৬টি কারণ দেখিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ভিসি খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন অনশন শুরু করেন কয়েকজন শিক্ষার্থীরা। শান্তিপূর্ণ টানা আন্দোলন চলছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ওই দিন আন্দোলনে ভিসি বাহিনী হামলা চালায়, এতে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়। এ হামলায় আন্দোলনের গতি আরও বাড়ে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় একজন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ভিসির পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন।
২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ইউজিসির তদন্ত দল। তদন্ত কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন করে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন প্রোক্টরিয়াল বডির ছাত্র উপদেষ্টা ও ফার্মেসি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তরিকুল ইসলাম। তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জানাচ্ছি, অহিংস আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ছাত্রদের ওপর বহিরাগত সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনের ফোনে খোলা কাগজ থেকে একাধিক বার কল করা হলেও কল রিসিভ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নুরউদ্দিন আহমেদ খোলা কাগজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। এক দফার আন্দোলন তো, সিদ্ধান্ত জানানোর অধিকার তো আমাদের নেই। এখানে আমার কিংবা আমার অফিসেরও কোনো ভূমিকা নেই। অন্য দাবি থাকলে সমাধানের পথ খুঁজতাম। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে এত ক্ষোভের জন্ম কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না। এতদিন শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।