উপাচার্যের উপআশ্চর্য কাজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯
আশ্চর্য সব কাণ্ড ঘটে চলছে। এসব কাণ্ডে দেশবাসীও যারপরনাই হতবাক। বালিশ, পর্দা, ঢেউটিন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাসিনো কাণ্ড- একটার পর একটা ঘটে চলছেই। এবার সেই পালে যোগ হওয়া কাণ্ডটি আশ্চর্য নয়, উপাচার্যের উপ-আশ্চর্য কাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান উপ-আশ্চর্য কাণ্ডের নামে জন্ম দিয়েছেন এক ‘রাজসিক’ ঘটনার!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বাংলোয় বসার জন্য দুটি চেয়ার ব্যবহার করেন। একটি অফিস কক্ষে। অন্যটি চা পান কক্ষে। প্রতিটির দাম ৫০ হাজার করে এক লাখ টাকা! বাংলোর অভ্যর্থনা কক্ষে বিশালাকার টেবিলটি ঘিরে রয়েছে ৩৮টি মিটিং চেয়ার। চেয়ারগুলোর দাম ১৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বৈঠকের জন্য ব্যবহৃত একেকটি চেয়ারের দাম ৩৮ হাজার টাকা! আর টেবিলটির দাম ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
উপাচার্যের বসার কক্ষে ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে ১৭টি সোফা। প্রতিটির দাম ৬২ হাজার টাকা করে। অফিস কক্ষের পাশেই ছোট মিটিং রুমের জন্য কেনা হয়েছে আরও চারটি চেয়ার, যার প্রতিটির দাম ৪০ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে উপাচার্যের বাড়ির জন্য শুধু আসবাবপত্রই কেনা হয়েছে মোট ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকার।
তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচার প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো জানায়, রাজধানীতে তাদের কোনো শো-রুমেই এত দামি চেয়ার নেই। আখতার ফার্নিচারের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের শো-রুমে সবচেয়ে দামি চেয়ারটি পাওয়া যায় ২৫ হাজার টাকায়। পারটেক্স গ্রুপের ম্যানেজার মো. আলমগীর হোসাইন জানান, তাদের কোনো চেয়ারের দামই ৩০ হাজারের বেশি নয়।
আসবাবপত্রের এমন অস্বাভাবিক দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান বললেন সহজ কথা। ‘আমি কখনোই দামি জিনিসপত্র ব্যবহার করিনি। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। দামি জিনিসপত্রের প্রতি আমার আগ্রহও নেই। এসব আসবাবপত্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটি কিনেছে। কমিটিতে যারা ছিলেন, এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হামলায় ঐতিহাসিক এ ভবনটির প্রায় সবকিছুই ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভবনটির সংস্কার ও নতুন করে কেনা হয় সব আসবাবপত্র।
জানা যায়, ওই হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হবে, তার বাজেট তৈরি করতে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। কমিটির প্রথম বৈঠকে উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারের মোট ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকার এক বাজেট অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে আসবাবপত্র কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। কোনো ধরনের উন্মুক্ত টেন্ডার ছাড়াই ‘কে রেহনুমা ইভেন্টস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে আসবাবপত্রগুলো সরবরাহের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম জানান, কমিটির নেতৃত্বে তিনি থাকলেও উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারের পুরো কাজটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা খুব বড় কোনো ইস্যু নয়। এসব নিয়ে কথা বলাটাই ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয়। যারা আপনাদের এসব তথ্য দিচ্ছে, তারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দিচ্ছে না।
জানা গেছে, উপাচার্যের বাসভবন সংস্কার ও আসবাবপত্রের সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকরাম হোসাইন। আসবাবপত্রের পেছনে এমন খরচের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র না দেখে আমি কিছুই বলতে পারব না। পুরো কাজই হয়েছে কমিটিপ্রধান, বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন স্যারের অনুমোদনে।’
অতিরিক্ত দাম রাখার অভিযোগ অস্বীকার ফার্নিচার কোম্পানির
এ বিষয়ে ফার্নিচার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কে রেহনুমা ইভেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেহনুমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা অন্য কারও কাছ থেকে চেয়ারগুলো কিনিনি। নিজস্ব কারখানায় তৈরি করা হয়েছে।’ দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক জানি না এত দামে চেয়ারগুলো বিক্রি করা হয়েছিল কি-না, তবে চেয়ারগুলোর দাম ২৮ থেকে ২৯ হাজার টাকার বেশি নয়। বিশ^বিদ্যালয় কমিটি হয়তো পার্সেন্টেজ হিসাব করে বাড়তি দামটুকু যোগ করে নিয়েছে।’
বরাদ্দ থাকার পরও তহবিল সংগ্রহ করেন অধ্যাপক শিবলী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য বার্ষিক একটি বাজেট বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে একাডেমিক ভবন, শিক্ষকদের বাসভবন এবং শিক্ষার্থীদের হলগুলোও অন্তর্ভুক্ত। উপাচার্যের বাসভবনের আসবাবপত্রগুলোও এ বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে কেনা হয়েছে। তবে কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, উপাচার্যের বাসভবনের সংস্কারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত। বাসভবনের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জিনিস’ কেনার নাম করে বাণিজ্য অনুষদের অন্তর্গত ৯টি বিভাগের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে সংগ্রহ করেন তিনি।
উপাচার্যের বাসভবনে হামলার চারদিন পর এ ৯টি বিভাগের চেয়ারম্যানকে নিয়ে একটি বৈঠক করেন তিনি। সেখানেই তহবিলের জন্য টাকা দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে উপাচার্যের বাসভবনে সংস্কারের জন্য যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বরাদ্দ রয়েছে, সেখানে আলাদা করে অধ্যাপক শিবলী কেন তহবিল সংগ্রহ করেছেন, সেটি নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, হামলার পর উপাচার্যের বাসভবনে আর কোনোকিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এমন জরুরি অবস্থায় আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে তারা অন্তত খাবার রান্না করে খেতে পারেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক তিন উপাচার্য বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে সাধারণ জনগণের টাকায়। সেই টাকার এমন ‘যথেচ্ছাচার ব্যবহার সত্যিই লজ্জাজনক’। নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য বলেন, ‘একজন মানুষ কী করে এত নিচে নেমে যেতে পারে, আমি জানি না। এ ব্যাপারে মন্তব্য করাটাও লজ্জার।’
তিনি বলেন, ‘আমি যতদিন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম, বাসভবনে অনেক পুরনো আসবাব ছিল। তাদের সংস্কার বা নতুন করে আসবাব কেনার কথা আমি চিন্তাও করিনি। একজন উপাচার্য হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আর গবেষণার মানোন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখা।’