জাবি উপাচার্যের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে তার বাসায় গত ৯ আগস্ট বৈঠক হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে। সেই বৈঠকে জাবি ছাত্রলীগকে ‘ঈদ সালামি’ হিসেবে ১ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে শাখা ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেছেন। জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানাকে ৫০ লাখ টাকা এবং সাধারণ সম্পাদক এসএম আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে ২৫ লাখ টাকা এবং অন্যরা ২৫ লাখ করে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জাবি শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসান তাজ ও শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ একাধিক নেতা টাকা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
জাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং সদ্য সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর মধ্যে একটি ফোনালাপেও শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা পাওয়া ও বাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়। ফোনালাপের অডিও রেকর্ডটি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু জাবি শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেছেন, টাকা দেওয়ার যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে তা মিথ্যে। এসব বন্ধ করা না হলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন। তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ইতোমধ্যে ইউজিসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ছাত্রলীগ নেতাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা থেকে কোটি টাকা চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে ভিসির সমালোচনা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল থেকে কড়া সমালোচনা করা হচ্ছে ভিসির। সাধারণ মানুষের করের টাকায় সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে, জাবি ভিসি উন্নয়ন বরাদ্দের সেই টাকা থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের ঈদ সালামির নামে চাঁদা দেওয়ায় তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে যদি কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে থাকেন তাহলে সেটা অনৈতিক কাজ হয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, ভিসির এমন কাণ্ডে তারা খুবই লজ্জিত। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান। আবার কেউ কেউ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তত পাঁচজন ভিসিকে চরম অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। কেন এমনটা হয়েছে তার কারণ খুঁজতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে বিষয়টি নিবিরভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য ইউজিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেন বলেছেন, কেউ কেউ উপাচার্যের এমন ঘটনা মেনে নিতে পারছে না, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন- জাবিতে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে শিক্ষকরা লজ্জিত। উন্নয়ন কাজের টাকায় ছাত্র-রাজনীতিকরা ভাগ বসায়, এখান থেকে টাকা চায়- এটি অচিন্তনীয়। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এসব ঘটছে। হয়তো এগুলো গণমাধ্যমে আসে না। ভাগাভাগিগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে, তা গণমাধ্যমে আসছে না। কেন তারা এসব করছে? শুধু কি শিক্ষার্থীদের দোষ? কারা তাদের ব্যবহার-অপব্যবহার করছে- এটি দেখতে হবে। আমরা দেখেছি প্রশাসন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যোগসাজশে অপকর্ম করছে। এগুলোও তদন্ত হওয়া উচিত। সততার শিক্ষা দেবেন শিক্ষকরা। এ শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি বলেই আমাদের সন্তানরা চাঁদাবাজি করছে। অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে এ ব্যর্থতা আমাদের। আমরা নানাভাবে সমাজকে কলুষিত করে চলছি। তার প্রভাব পড়ছে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ওপর।
শিক্ষার জন্য আন্দোলন করেছে যে জাতি সে জাতির তো কোনো অন্যায় করার কথা না, কোনো দুর্নীতি করার কথা না। একজন সুশিক্ষিত মানুষ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না, সুশিক্ষিত মানুষ দুর্নীতি করতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখছি, যিনি দুর্নীতি করছেন তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। কিসের উচ্চশিক্ষা? এটি তথাকথিত উচ্চশিক্ষা, তার শুধু সনদ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ কথাটিই বলে গেছেন যে, সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুষ চাওয়ার অপরাধে ছাত্রলীগের যে দুই শীর্ষ নেতাকে পদচ্যুত করা হয়েছে- ওটার আবার নতুন নাম দিয়েছে ‘ফেয়ার শেয়ার’। অর্থাৎ ৫ অথবা ১০ শতাংশ ঘুষ যে নেবে এটা হলো ‘ফেয়ার শেয়ার’। এ ফেয়ার শেয়ারের মধ্যে আবার এখন ভিসির নামও চলে এসেছে। উনি নাকি ইতিমধ্যে ১ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। তাহলে এ দুই ছাত্র (ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) কেন? দ্রুত ভিসির পদত্যাগ করা উচিত অথবা তাকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ হলে, নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ এলে, সেটা যদি তদন্ত করে প্রমাণ হয়- তিনিও কোনো আইনের ঊর্ধ্বে নন। তিনি যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, এখানে যদি তার কোনো অপকর্মের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেন ভিসিরা সম্মান নিয়ে ফিরতে পারেন না : অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাঁচজন ভিসিকে পর পর কিভাবে বিদায় নিয়ে আসতে হয়েছে তা দেখতে হবে। কেন তাদের এভাবে আসতে হয়েছে তার উত্তর খুঁজতে হবে। মনে প্রশ্ন আসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভিসি থাকতে পারছেন না কেন? আর যাদের বিদায় হতে হচ্ছে তাদের একটি পরিচয় আছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমানে ভিসি পাঁচ বছর কাটালেন কোনো দুর্নীতি নেই। হঠাৎ কেন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। আগে যে পাঁচজন বিদায় নিয়েছেন প্রত্যেকেরই একাডেমিক রেকর্ড চমৎকার। কিন্তু তাদের পরিণতি কেন এমন হলো।
নিশ্চয় ওখানে এমন একটি শক্তি আছে, যে শক্তির কারণে তারা টিকতে পারছেন না। সেটা খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা আমরা জানব না। ভিসি নিজেই বলেছেন তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি ইউজিসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলেছেন, তারা যেন বিষয়টি তদন্ত করে দেখে। আমার তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন ওখানে (জাবি) ভিসিরা গিয়ে কেন সম্মানের সঙ্গে ফিরতে পারেন না?