ফয়সালা হয়নি দুর্নীতির তদন্ত
জাবিতে অচলাবস্থা চলছেই
জাবি প্রতিনিধি
🕐 ১০:৩৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার মেগা প্রকল্প থেকে দুই কোটি টাকা ছাত্রলীগের মধ্যে বণ্টনের অভিযোগে গড়ে ওঠা সংকট সমাধানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় দুটি দাবি মেনে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দুর্নীতির নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়টি অমীমাংসিত রেখেই আলোচনা শেষ হওয়ায় উদ্ভূত অচলাবস্থা কাটেনি বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
গত বৃহস্পতিবার বিকাল পৌনে ৪টায় নতুন প্রশাসনিক ভবনে আলোচনা শুরু হয়ে চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারী ২২ শিক্ষক-শিক্ষার্থী আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি দাবি মেনে নিয়েছেন বলে জানান, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম ও তৃতীয় দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেনে নিয়েছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের দ্বিতীয় দাবির ক্ষেত্রে তারা সময় নিয়েছেন।’ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেটা নিরপেক্ষ তদন্ত না করা হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
আশিকুর আরও বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তর-পশ্চিম পাশের হলটি ১০০ ফিট দূরে এবং দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের নির্মিতব্য হল দুটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ, বিশেষায়িত ও মনিটরিং নামে তিনটি কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মাস্টারপ্ল্যান পুনর্গঠন ও প্রকল্পের স্বচ্ছতার বিষয়ে সার্বিক তদারকি করবে।’ দুর্নীতি তদন্তের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী বুধবার আবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে প্রশাসন।
আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে অংশ নেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আমির হোসেন ও অধ্যাপক নূরুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ, প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) আহসান হাবিব। আন্দোলনকারীদের পক্ষে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক খবির উদ্দিন, অধ্যাপক জামাল উদ্দিন, অধ্যাপক কামরুল আহসান, অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, অধ্যাপক রায়হান রাইন, অধ্যাপক তারেক রেজা প্রমুখ। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
এর আগে তিন দফা দাবিতে গত ৩, ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর টানা তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। ৫ সেপ্টেম্বর অবরোধ চলাকালে উপাচার্য তাদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলে আন্দোলনকারীরা দাবির ব্যাপারে ‘আন্তরিকতার’ শর্তে প্রস্তাবে রাজি হন। ৭ সেপ্টেম্বর আলোচনা শুরুর আগ মুহূর্তে আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীকে এক ছাত্রলীগ নেতার মারধরের ঘটনায় আলোচনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে প্রশাসন ওই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করলে নতুন করে আলোচনার পরিবেশ তৈরি হয়।
এদিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ৪-৬ পারসেন্ট চাঁদা দাবি করেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।
৮ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে এ চাঁদা দাবি করেন তারা। উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে- এমন কোম্পানির কাছ থেকে উপাচার্যকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন শোভন ও রাব্বানী। তাদের এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার সঙ্গে দুই নেতা রূঢ় আচরণ করেন।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলন নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আধা ঘণ্টার বেশি আলোচনা করেছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমার প্রতি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন। ভিসি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, ওরা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও কষ্ট দিল।’
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা উপাচার্য ম্যামের সঙ্গে দেখা করেছি, সেটা সত্য। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি মোটেও ঠিক নয়। তিনি ঈদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তার একটি টাকাও আমাদের ছিল না। অথচ বলা হচ্ছিল, আমাদের টাকা দেওয়া হয়েছে। পরে তার ছেলের মাধ্যমে তিনি আমাদের কল করিয়েছেন। তখন আমরা সেখানে গিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার একটি কাজের জন্য আমাদের ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় ভাইয়ের ফার্মের জন্য বলেছিলাম। ভিসি ম্যাম সেই ফার্মকেও কাজটা দেননি। আমরা সেটা নিয়েও কিছু বলিনি। অথচ এখন উল্টো আমাদের নামে বলা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, সেখানে আমরা কিছু করিনি। কেউ আমাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলতে পারেনি। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কেন করব।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে লেখা এক চিঠিতে উপাচার্য ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন গোলাম রাব্বানী। চিঠিতে তিনি দাবি করেছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অভিযোগ আপনার কাছে ভিন্নভাবে উত্থাপন করা হয়েছে। উপাচার্য ম্যামের স্বামী ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে কাজের ডিলিংস করে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল আজহার আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
এ খবর জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হয় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ম্যাম আমাদের স্মরণ করেন। আমরা দেখা করে আমাদের অজ্ঞাতসারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিব্রতবোধ করেন। নেত্রী, ওই পরিস্থিতিতে আমরা কিছু কথা বলি, যা সমীচীন হয়নি। এ জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’