ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সমালোচনা মাত্রই বহিষ্কার

ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:০০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

কথায় কথায় শোকজ, সমালোচনা করলেই বহিষ্কার। এমন ঘটনা ঘটছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি)। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বললে কিংবা লিখলে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কারের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরে বিভিন্ন মেয়াদে ৩৪ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

সর্বশেষ গত বুধবার ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ তুলে বহিষ্কার করা হয়েছে আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ডেইলি সান পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ আগস্ট জিনিয়া তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কি হওয়া উচিত’। ওই স্ট্যাটাসে অনেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করেন। এর জেরে বহিষ্কার করা হয় তাকে।

জিনিয়া খোলা কাগজকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে লেখার জের ধরেই বহিষ্কার করা হয়েছে। জিনিয়া বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বললেই অপরাধ। যৌক্তিক কোনো বিষয়েও নিউজ করার নিয়ম নেই এখানে।

জানা গেছে, ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, উন্নয়ন ফির নামে অনিয়ম, কাল্পনিক প্রকল্পে বরাদ্দ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে-বেনামে হুমকি পেয়েছেন। সর্বশেষ তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এর আগে, ৫ সেপ্টেম্বর ফেসবুকের আরেকটি পোস্টকে কেন্দ্র করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তখন বশেমুরবিপ্রবির রেজিস্ট্রার ড. নূরউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ছাত্র হাবিবুল্লাহ নিয়ন এবং তার কয়েকজন সহযোগী শিক্ষার্থী ক্লাসরুমের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপ্রীতিকর মন্তব্য লেখে যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তাই তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বশেমুরবিপ্রবির এক সংবাদকর্মী জানান, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কমন বিষয় হলো, ভিসির বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই বহিষ্কার। তিনি বলেন, গাছ-লতাপাতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে কোনো নিউজ আমরা কাভার করতে পারি না। এখানে অন্যরকম স্বৈরশাসন চলে, আমরা কি লিখব এবং কি লিখব না, এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্ধারণ করে দেয়।

বশেমুরবিপ্রবির সাংবাদিক সমিতির সদস্য ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিষ্কারের ঘটনায় সারা দেশের ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংবাদিক সংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রায়হানুল ইসলাম আবির খোলা কাগজকে বলেন, ‘বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করছেন। এমন অনেক প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।

আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা জিনিয়াকে বহিষ্কারের ব্যাপারে কোনো যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার না করলে, আমরা সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামব।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিলয় মামুন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরতান্ত্রিক প্রভাব ঠেকানো না গেলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের মতো এমন ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে।’

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া খোলা কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি হচ্ছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি তাদের কথা বলতে না পারেন, মত প্রকাশ করতে না পারেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বলে আসলে অন্য কিছু থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো করে কেউ শিখতে যায় না। শিক্ষার্থীর চিন্তার বিকাশ ঘটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধারাবাহিকতা দেখছি, ভাবমূর্তি রক্ষার কথা বলে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়া, বিভিন্ন অজুহাতে ব্যক্তিগতভাবে তাদের নাজেহাল করাসহ আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আইনের কথা বলে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যা আইনের ব্যাখার মধ্যে পড়ে না।

তিনি বলেন, আজগুবি সব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউকে বহিষ্কার করা মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে শিখাবে বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে গলা চেপে ধরার জন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার পরিপন্থী।

এ সব বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনের ফোনে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর আশিকুজ্জামান ভূইয়া খোলা কাগজকে জানান, ‘জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সালমানের সঙ্গে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ভিসির আইডি হ্যাক করার বিষয়ে কথা বলেছে।’ তিনি জানান, আইডি হ্যাক হয়নি, তবে চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাকে (জিনিয়া) বহিষ্কার করা হয়েছে।

ক্যাম্পাসের সংবাদকর্মীদের নিউজ করতে বাধা দেওয়ার বিষয়ে প্রক্টর বলেন, ‘আমরা চাই না, কোনো নেগেটিভ নিউজের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক। আমরা তাদের (সংবাদকর্মী) বলেছি, কোনো অসংগতি দেখলে আমাদের জানাও, আমরা সমাধান করব।’

 
Electronic Paper