উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গ (৪)
উচ্চশিক্ষাতেও বৈষম্য
মনোজ দে
🕐 ১০:২৭ অপরাহ্ণ, জুন ১০, ২০১৯
নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতেই উচ্চশিক্ষা অবহেলিত। রংপুর বিভাগের আট জেলার দুই কোটি মানুষের উচ্চশিক্ষার জন্য মাত্র দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর একটি বিভাগীয় শহর রংপুরে। রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু মাত্র ২০০৮ সালে।
এ ছাড়া এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য দিনাজপুরে একটি বিশেষায়িত হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ১৯৭৮ সালে কৃষি ইনস্টিটিউট হিসাবে যাত্রা শুরুর পর ২০০০ সালে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে তিন হাজার শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা নগণ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ এখানকার মানুষ উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অথচ সেই ১৯১৬ সালে রংপুরে উচ্চশিক্ষার জন্য কার মাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রথম প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর একটি এটি। ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটি একসময় উত্তরবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। প্রাচীন এ জনপদে কার মাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে সময় লেগে গেছে ৯০ বছর। রাষ্ট্র ও সরকারের উদাসীনতা ও রংপুরের প্রতি বৈষম্যনীতির কারণে এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
শুধু রংপুর বিভাগ নয় পুরো উত্তরবঙ্গেই শিক্ষাক্ষেত্রে এ বৈষম্য রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার দুই কোটি মানুষের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র তিনটি। এর মধ্যে দুটিই রাজশাহীতে, অন্যটি পাবনাতে। ১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর ধারণক্ষম বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তরাঞ্চলের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাজশাহীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও সারা দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন।
এ ছাড়া ৩০০০ শিক্ষার্থী ধারণক্ষম রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৭০০ শিক্ষার্থী ধারণক্ষম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান।
তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা অববাহিকায় গড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের একটা বড় অংশে এক সময়কার বরেন্দ্র সভ্যতা গড়ে ওঠে। উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার একটি এটি। বিস্তীর্ণ সমতলভূমি, পানির সহজলভ্যতার কারণে এ অঞ্চলে আগে থেকেই খাদ্যের প্রাচুর্য ছিল। বৌদ্ধ আমলে পাহাড়পুরে গড়ে ওঠে ইতিহাস বিখ্যাত সোমপুর বিহার। একসময় চীন, তিব্বতসহ দূর-দূরান্ত থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই বিহারে শিক্ষা নিতে আসতেন। জ্ঞানচর্চার এ জনপদেই উচ্চশিক্ষা আজ অবহেলিত।
উত্তরবঙ্গবাসীদের উচ্চশিক্ষায় এই অবস্থার পেছনে সরকারের নীতি ও সদিচ্ছার অভাব দায়ী বলে মনে করছেন সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক শারমিনুর নাহার। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণীরা উত্তরবঙ্গের সমস্যা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ জেলা কৃষিপ্রধান হওয়ায় এখানকার অর্থনীতি থেকে জিডিপিতে যুক্ত হচ্ছে কম অংশ। এখানকার কৃষিপণ্য থেকে যারা লাভবান হচ্ছেন মানে মধ্যস্বত্বভোগীরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাইরের জেলার। টাকার অঙ্কে অর্থনীতিতে কম অবদানের জন্যই রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণীদের এমন বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণেই উত্তরবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে তাদের অনাগ্রহ।
শারমিনুর বলেন, উত্তরবঙ্গে এখন যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেখানে ১৬টি জেলার মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, রংপুরের মতো জেলাগুলো থেকেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বেশি সুযোগ পাচ্ছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলো থেকে কম শিক্ষার্থী এ সুযোগ নিতে পারছে। পিছিয়ে পড়ার কারণে এসব অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরির জন্য সরকারে বিশেষ নজর থাকা দরকার ছিল। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটছে।
উত্তরবঙ্গে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো গত কয়েকবছরে যাত্রা শুরু করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি বলেই মনে করেন তিনি। বলেন, উত্তরবঙ্গ মূলত কৃষিপ্রধান। এখানকার মাটি ও মানুষের বিষয়গুলো বিবেচনা করে কৃষি ও কৃষি প্রযুক্তিনির্ভর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার ছিল।