বিস্ময় জাগালো মেয়েরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০৬ অপরাহ্ণ, মে ০৬, ২০১৯
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় টানা চতুর্থবারের মতো সর্বোচ্চ পাসের হার দেখিয়ে রীতিমতো বিস্ময় তৈরি করেছে মেয়েরা। এবার ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, যাদের মধ্যে ছেলেদের পাসের হার ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মেয়েদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে গতবারের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। অপরদিকে পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৫ হাজার ৩৫ জন। জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে মেয়েরা। মেয়েদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন এবং ছেলেদের মধ্যে পেয়েছে ৫২ হাজার ১১০ জন।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। অন্যবার বোর্ড চেয়ারম্যানরা এসএসসি ও সমানের পরীক্ষার ফলাফলের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় এবার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ফলাফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করেন বোর্ড চেয়ারম্যানরা। এসময় শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় আটটি সাধারণ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বোর্ড মিলিয়ে ১০টি বোর্ডে ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন। পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ জন ছাত্র এবং ৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৯৫ জন ছাত্রী। টানা চতুর্থবারের মতো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা।
এ বছর ছেলেদের পাসের হার ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মেয়েদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত বছর ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৭৬.৭১ শতাংশ। আর ছাত্রীদের পাসের হার ৭৮ শতাংশ। শুধু পাসের হারে নয়, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে মেয়েরা। এবার মেয়েদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন এবং ছেলেদের মধ্যে পেয়েছে ৫২ হাজার ১১০ জন। ১ হাজার ৩৭৪ জন মেয়ে জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে। এবার শতভাগ পাস করেছে ২৫৮৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ১০৭ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনও পাস করেনি।
ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, গতবার আটটি সাধারণ বোর্ড থেকে ৭৯ দশমিক ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৩৫ জন। এবার আটটি সাধারণ বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪ হাজার ৫৫৬ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিলে এবার ৮৩ দশমিক ০৩ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ২৮৭ জন। গতবার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৭০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৩ হাজার ৩৭১ জন।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এবার ৭২ দশমিক ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৫১ জন। এই বোর্ডে গতবার পাসের হার ছিল ৭১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪ হাজার ৪১৩ জন। সব মিলিয়ে এবার পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৫ হাজার ৩৫ জন।
সকালে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার পর দুপুর ১২টা থেকে অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় বিভিন্ন বোর্ডের ফল। এছাড়া শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট থেকেও পরীক্ষার্থীরা ফল সংগ্রহ করে। প্রতিবারের মতো যথারীতি মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমেও ফল সংগ্রহ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
বোর্ডওয়ারি ফলাফলে দেখা গেছে, পাসের হারের দিক থেকে এগিয়ে আছে রাজশাহী বোর্ড। ৯১.৬৪ শতাংশ এ বোর্ডের পাসের হার। এখান থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২২,২৯৫ জন। আবার জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে আছে ঢাকা বোর্ড। ৭৯.৬২ শতাংশ পাসের হার নিয়ে এ বোর্ড থেকে ডিজিএ-৫ পেয়েছে ২৯,৬৮৭ শিক্ষার্থী। ৯০.৮৮ শতাংশ পাসের হার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যশোর বোর্ড। তার পরের অবস্থানে রয়েছে কুমিল্লা। এ বোর্ডের পাসের হার ৮৭.১৮। এরপর দিনাজপুর ৮৪.১০ শতাংশ, চট্টগ্রাম ৭৮.১১, বরিশাল ৭৭.৪১ এবং সিলেট ৭০.৮৩ শতাংশ। যশোর থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯,৯৪৮ জন, কুমিল্লা থেকে ৮,৭৬৪ জন, দিনাজপুর থেকে ৯,০২৩ জন, চট্টগ্রাম থেকে ৭,৩৯৩ জন, বরিশাল থেকে ৪,১৮৯ জন, সিলেট থেকে ২,৭৫৭ জন শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৮৩.০৩ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৭২.২৪ শতাংশ। যথাক্রমে এ দুই বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬,২৮৭ ও ৪,৭৫১ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর হার-দুদিক থেকেই একেবারে নিচে রয়েছে সিলেট বোর্ড।
শতভাগ পাস ২৫৮৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে : এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি ও মাদ্রাসা বোর্ডে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৫৮৩টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৭৪টি। গত বছরের তুলনায় এ বছর সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৯টি।
কেউ পাস করেনি ১০৭ স্কুলে : ১০৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি এ বছর। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১০৯। এবার বরিশাল বোর্ডের দুটি এবং দিনাজপুর, রাজশাহী ও যশোর বোর্ডের একটি করে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বোর্ডে এবার এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। অন্যদিকে মাদ্রাসা বোর্ডের ৫৯টি ও কারিগরি বোর্ডেল ৪৩টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।
সব দিকেই এগিয়ে মেয়েরা : এসএসসিতে এবার পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে ছাত্রদের পেছনে ফেলেছে ছাত্রীরা।
গতবার পাসের হারের দিক থেকে ছাত্রীরা এগিয়ে থাকলেও বেশি সংখ্যক ছাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছিল। এবার এই দুই সূচকই দখলে নিয়ে নিয়েছে ছাত্রীরা। আট বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৯৫ জন ছাত্রী পাস করেছে। ছাত্রীদের পাসের হার ৮৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৮২ দশমিক ০১ শতাংশ। অন্যদিকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২ হাজার ১১০ জন ছাত্র এবং ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন ছাত্রী। এবার ছাত্রদের চেয়ে এক হাজার ৩৭৪ বেশি ছাত্রী পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পেয়েছে।
শীর্ষে রাজশাহী, পিছিয়ে সিলেট : এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৯১.৬৪ শতাংশ। গত বছর রাজশাহীতে পাসের হার ছিল ৮৬.০৭ শতাংশ। গত বছরের মতো এ বছরও পাসের দিক দিয়ে পিছিয়ে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। এ বছর পাসের হার ৭০.৮৩ শতাংশ। যা গত বছর এ হার ছিল ৭০.৪২ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের উল্লাস : এদিকে এসএসসির ফল প্রকাশের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বস্তরে উল্লাস করেছে পরীক্ষায় কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার পর অনলাইনে ফল পেয়ে নিজেদের স্কুলে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তারা আননন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করে। বিভিন্ন স্কুলে ব্যান্ড বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ উদযাপন করতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে যোগ দেন শিক্ষক ও অভিভাবকরাও। অনেক অভিভাবকের চোখে এসময় আনন্দ-অশ্রু দেখা যায়। মিষ্টিমুখ করিয়ে সন্তানদের সাফল্য উদযাপন করে শিক্ষক অভিভাবকরাও। এসএসসির ফল প্রকাশকে কেন্দ্র বাড়তি ভীড় ছিল দেশের মিষ্টির দোকানগুলোতে। ব্যবসায়ীরাও চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাড়তি মিষ্টান্ন তৈরি করে রেখেছিলেন দোকানে।
এসএসসি উত্তীর্ণদের প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন অনুত্তীর্ণদের জন্য সাহস
এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় যারা ভালো করেছে তারা ভবিষ্যতে আরও ভালো ফল অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি অনুত্তীর্ণদের আগামীতে ভালো ফল করার সাহসও জু?গিয়েছেন তিনি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সোমবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থানরত শেখ হাসিনা এক মোবাইল বার্তায় এসব কথা বলেন।
এদিন বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফল প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ সময় দীপু মনি প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত একটি বাণী পড়ে শোনান। এরপরই হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রীর মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে লাউড স্পিকারে ভেসে এলো প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর। লন্ডনে অবস্থানরত শেখ হাসিনা শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে তিনি অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মনোবলকে আরও শক্ত করে আগামীর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
সরকারপ্রধান ফোনে বলেন, ‘এখানে এখন অনেক ভোর। আমি আনন্দমুখর এ সময়টির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আমি ফল ঘোষণার এ মুহূর্তটিতে অংশ নিয়ে আসছি। লন্ডনে থাকায় এবার আমি ফল ঘোষণার সময় উপস্থিত না থাকতে পারলেও আপনাদের সঙ্গেই আছি।’
ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা পাস করেছ, তোমাদের সবাইকে অভিনন্দন। এ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই তোমাদের নিজেদের আগামী দিনের জন্য যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশ ও জাতির সেবায় তোমরা এগিয়ে আসবে। জাতি তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। উজ্জ্বল ও সোনালি ভবিষ্যৎ তোমরাই রচনা করবে। তোমাদের হাত দিয়েই সোনার বাংলা সোনায় ভরে উঠবে। তোমাদের সবার জন্য দোয়া রইল।’
অকৃতকার্যদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন থেকেই মনোযোগ দিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করবে। আগামীতে তোমরা আরও ভালো ফল করবে, এটা আমার প্রত্যাশা। অভিভাবকদের এ মুহূর্তে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।
এ বছর ভালো ফলের জন্য প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান।